রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - বনচরগণ ও অর্জ্জুন (চিত্রাঙ্গদা)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বনচর

হায় হায় কে রক্ষা করিবে?

অর্জ্জুন

কি হয়েছে

বনচর

উত্তর পর্ব্বত হ\’তে আসিছে ছুটিয়া
দস্যুদল, বরষার পার্ব্বত্য বন্যার
মত বেগে, বিনাশ করিতে লােকালয়।

অর্জ্জুন

এ রাজ্যে রক্ষক কেহ নাই?

বনচর

রাজকন্যা
চিত্রাঙ্গদা আছিলেন দুষ্টের দমন;
তাঁর ভয়ে রাজ্যে নাহি ছিল কোনাে ভয়,
যমভয় ছাড়া। শুনেছি গেছেন তিনি
তীর্থপর্যটনে, অজ্ঞাত ভ্রমণব্রত।

অর্জ্জুন

এ রাজ্যের রক্ষক রমণী?

বনচর

এক দেহে
তিনি পিতামাতা অনুরক্ত প্রজাদের।
স্নেহে তিনি রাজমাতা, বীর্য্যে যুবরাজ।

(প্রস্থান)

( চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ)

চিত্রাঙ্গদা

কি ভাবিছ নাথ?

অর্জ্জুন

রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
কেমন না জানি তাই ভাবিতেছি মনে।
প্রতিদিন শুনিতেছি শতমুখ হ\’তে
তারি কথা, নব নব অপূর্ব্ব কাহিনী।

চিত্রাঙ্গদা

কুৎসিত, কুরূপ! এমন বঙ্কিম ভুরু
নাই তা\’র, এমন নিবিড় কৃষ্ণতারা।
কঠিন সবল বাহু বিঁধিতে শিখেছে
লক্ষ্য, বাঁধিতে পারে না বীরতনু, হেন
সুকোমল নাগপাশে।

অর্জ্জুন

কিন্তু শুনিয়াছি,
স্নেহে নারী বীর্য্যে সে পুরুষ।

চিত্রাঙ্গদা

ছি ছি, সেই
তা’র মন্দভাগ্য। নারী যদি নারী হয়
শুধু, শুধু ধরণীর শােভা, শুধু আলাে,
শুধু ভালবাসা, শুধু সুমধুর ছলে,
শতরূপ ভঙ্গিমায় পলকে পলকে
লুটায়ে জড়ায়ে বেঁকে বেঁধে হেসে কেঁদে
সেবায় সােহাগে ছেয়ে চেয়ে থাকে সদা
তবে তা\’র সার্থক জনম। কি হইবে
কর্ম্মকীর্ত্তি বীর্য্যবল শিক্ষা দীক্ষা তা\’র।
হে পৌরব, কাল যদি দেখিতে তাহারে
এই বনপথপার্শ্বে, এই পূর্ণাতীরে,
ওই দেবালয় মাঝে-হেসে চলে\’ যেতে।
হায় হায়, আজ এত হয়েছে অরুচি
নারীর সৌন্দর্য্যে, নারীতে খুঁজিতে চাও
পৌরুষের স্বাদ।

এস নাথ, ওই দেখ
গাঢ়চ্ছায়া শৈলগুহামুখে, বিছাইয়া
রাখিয়াছি আমাদের মধ্যাহ্ন-শয়ন,
কচি কচি পীতশ্যাম কিশলয় তুলি’
আর্দ্র করি’ ঝরণার শীকরনিকরে।
গভীর পল্লবছায়ে বসি’, ক্লান্তকণ্ঠে

কঁদিছে কপােত, “বেলা যায়” “বেলা যায়”
বলি\’। কুলুকুলু বহিয়া চলেছে নদী
ছায়াতল দিয়া। শিলাখণ্ডে স্তরে স্তরে
সরস সুস্নিগ্ধ সিক্ত শ্যামল শৈবাল
নয়ন চুম্বন করে কোমল অধরে।
এস নাথ বিরল বিরামে।

অৰ্জ্জুন

আজ নহে
প্রিয়ে!

চিত্রাঙ্গদা

কেন নাথ?

অর্জ্জুন

শুনিয়াছি দস্যুদল
আসিছে নাশিতে জনপদ। ভীতজনে
করিব রক্ষণ।

চিত্রাঙ্গদা

কোনাে ভয় নাই প্রভু!
তীর্থযাত্রাকালে, রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা
স্থাপন করিয়া গেছে সতর্ক প্রহরী
দিকে দিকে; বিপদের যত পথ ছিল
বন্ধ করে\’ দিয়ে গেছে বহু তর্ক করি\’।

অর্জ্জুন

তবু আজ্ঞা কর, প্রিয়ে স্বল্পকালতরে
করে\’ আসি কর্ত্তব্যসন্ধান। বহুদিন
রয়েছে অলস হ\’য়ে ক্ষত্রিয়ের বাহু।
সুমধ্যমে, ক্ষীণকীর্ত্তি এই ভুজদ্বয়
পুনর্ব্বার নবীন গৌরবে ভরি’ আনি’
তােমার মস্তকতলে যতনে রাখিয়া
দিব, হবে তব যােগ্য উপধান।

চিত্রাঙ্গদা

যদি
নাই যেতে দিই? যদি বেঁধে রাখি? ছিন্ন
করে’ যাবে? তাই যাও। কিন্তু মনে রেখাে
ছিন্ন লতা জোড়া নাহি লাগে। যদি তৃপ্তি
হ\’য়ে থাকে, তবে যাও, করিব না মানা;
যদি তৃপ্তি নাহি হ\’য়ে থাকে, তবে মনে
রেখাে, চঞ্চলা সুখের লক্ষী কারাে তরে
বসে’ নাহি থাকে; সে কাহারাে সেবাদাসী
নহে; তা\’র সেবা করে নরনারী, অতি
ভয়ে ভয়ে নিশিদিন রাখে চোখে চোখে
যতদিন প্রসন্ন সে থাকে। রেখে যাবে।
যারে সুখের কলিকা, কর্মক্ষেত্র হ\’তে
ফিরে এসে সন্ধ্যাকালে দেখিবে তাহার

দলগুলি ফুটে\’ ঝরে\’ পড়ে\’ গেছে ভূমে;
সব কর্ম্ম ব্যর্থ মনে হবে। চিরদিন
রহিবে জীবনমাঝে জীবন্ত অতৃপ্তি
ক্ষুধাতুরা। এস, নাথ, বস\’। কেন আজি
এত অন্যমন? কার কথা ভাবিতেছ?
চিত্রাঙ্গদা? আজ তা\’র এত ভাগ্য কেন?

অর্জ্জুন

ভাবিতেছি বীরাঙ্গনা কিসের লাগিয়া
ধরেছে দুষ্কর ব্রত? কি অভাব তা\’র?

চিত্রাঙ্গদা

কি অভাব তা’র? কি ছিল সে অভাগীর?
বীর্য্য তা’র অভ্রভেদী দুর্গ সুদুর্গম
রেখেছিল চতুর্দ্দিকে অবরুদ্ধ করি’
রুদ্যমান রমণীহৃদয়। রমণী ত
সহজেই অন্তরবাসিনী; সঙ্গোপনে
থাকে আপনাতে; কে তা\’রে দেখিতে পায়,
হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেহের শােভায়
প্রকাশ না পায় যদি। কি অভাব তা’র?
অরুণ-লাবণ্য-লেখা-চিরনির্ব্বাপিত
ঊষার মতন, যে রমণী আপনার
শতস্তর তিমিরের তলে বসে\’ থাকে
বীর্য্যশৈলশৃঙ্গপরে নিত্য-একাকিনী

কি অভাব তা’র? থাক থাক, তা\’র কথা।
পুরুষের শ্রুতি-সুমধুর নহে, তা\’র
ইতিহাস!

অর্জ্জুন

বল বল। শ্রবণলালসা
ক্রমশঃ বাড়িছে মাের। হৃদয় তাহার
করিতেছি অনুভব হৃদয়ের মাঝে।
যেন পান্থ আমি, প্রবেশ করেছি গিয়া
কোন্ অপরূপ দেশে অর্দ্ধ রজনীতে।
নদীগিরিবনভূমি সুপ্তিনিমগন,
শুভ্রসৌধকিরীটিনী উদার নগরী
ছায়াসম অর্দ্ধস্ফুট দেখা যায়, শুনা
যায় সাগরগর্জ্জন; প্রভাতআকাশে
বিচিত্র বিস্ময়ে যেন ফুটিবে চৌদিক;
প্রতীক্ষা করিয়া আছি উৎসুক হৃদয়ে
তারি তরে। বল বল শুনি তা\’র কথা।

চিত্রাঙ্গদা

কি আর শুনিবে?

অর্জ্জুন

দেখিতে পেতেছি তা\’রে
অশ্বারােহী, অবহেলে বাম করে বল্লা
ধরি’, দক্ষিণেতে শরাসন, নগরের

বিজয়লক্ষনীর মত, আর্ত্ত প্রজাগণে
করিছেন বরাভয়দান। দরিদ্রের
সঙ্কীর্ণ দুয়ারে, রাজার মহিমা যেথা
নত হয় প্রবেশ করিতে, মাতৃরূপ
ধরি’ সেথা, করিছেন দয়াবিতরণ।
সিংহিনীর মত, চারিদিকে আপনার
বৎসগণে রয়েছেন আগলিয়া, শত্রু
কেহ কাছে নাহি আসে ডরে। ফিরিছেন
মুক্তলজ্জা, ভয়হীনা, প্রসন্নহাসিনী,
বীর্য্যসিংহ পরে চড়ি’ জগদ্ধাত্রী দয়া।
রমণীর কমনীয় দুই বাহু পরে
স্বাধীন সে অসঙ্কোচ বল, ধিক্ থাক
তা\’র কাছে রুনুঝুনু কঙ্কণ কিঙ্কিণী।
অয়ি বরারোহে, বহুদিন কর্ম্মহীন
এ পরাণ মাের, উঠিছে অশান্ত হ\’য়ে
দীর্ঘ শীত-সুপ্তোথিত ভুজঙ্গের মত।
এস এস দোঁহে দুই মত্ত অশ্ব ল\’য়ে
পাশাপাশি ছুটে চলে\’ যাই, মহাবেগে
দুই দীপ্ত জ্যোতিষ্কের মত। বাহিরিয়া
যাই, এই রুদ্ধ সমীরণ, এই তিক্ত
পুষ্পগন্ধমদিরায় নিদ্রাঘনঘাের
অরণ্যের অন্ধগর্ভ হ\’তে।

চিত্রাঙ্গদা

হে কৌন্তেয়,
যদি এ লালিত্য, এই কোমল ভীরুতা,
স্পর্শক্লেশসকাতর শিরীষপেলব
এই রূপ, ছিন্ন করে\’ ঘৃণাভরে ফেলি\’
পদতলে, পরের বসনখণ্ড সম,—
সে ক্ষতি কি সহিতে পারিবে? কামিনীর
ছলাকলা মায়ামন্ত্র দূর করে\’ দিয়ে
উঠিয়া দাঁড়াই যদি সরল উন্নত
বীর্য্যমন্ত অন্তরের বলে, পর্ব্বতের
তেজস্বী তরুণ তরুসম, বায়ুভরে
আনম্রসুন্দর, কিন্তু লতিকার মত
নহে নিত্য কুণ্ঠিত লুণ্ঠিত,—সেকি ভালাে
লাগিবে পুরুষচোখে?—থাক থাক, তা\’র
চেয়ে এই ভালো। আপন যৌবনখানি,
দুদিনের বহুমূল্য ধন, সাজাইয়া
সযতনে, পথচেয়ে বসিয়া রহিব;
অবসরে আসিবে যখন, আপনার
সুধাটুকু দেহপাত্রে আকর্ণ পূরিয়া
করাইব পান; সুখস্বাদে শ্রান্তি হ\’লে
চলে\’ যাবে কর্ম্মের সন্ধানে; পুরাতন
হ\’লে, যেথা স্থান দিবে, সেথায় রহিব

পার্শ্বে পড়ি। যামিনীর নর্ম্মসহচরী
যদি হয় দিবসের কর্ম্মসহচরী,
সতত প্রস্তুত থাকে বামহস্তসম
দক্ষিণ হস্তের অনুচর, সে কি ভালাে
লাগিবে বীরের প্রাণে?

অৰ্জ্জুন

বুঝিতে পারিনে
আমি রহস্য তােমার। এতদিন আছি,
তবু যেন পাইনি সন্ধান। তুমি যেন
বঞ্চিত করিছ মােরে গুপ্ত থেকে সদা;
তুমি যেন দেবীর মতন, প্রতিমার
অন্তরালে থেকে, আমারে করিছ দান
অমূল্য চুম্বন রত্ন, আলিঙ্গন সুধা;
নিজে কিছু চাই না, লহ না। অঙ্গহীন
ছন্দোহীন প্রেম প্রতিক্ষণে পরিতাপ
জাগায় অন্তরে। তেজস্বিনী, পরিচয়
পাই তব মাঝে মাঝে কথায় কথায়।
তা\’র কাছে এ সৌন্দর্যরাশি, মনে হয়
মৃত্তিকার মূর্ত্তি শুধু, নিপুণ চিত্রিত
শিল্প যবনিকা। মাঝে মাঝে মনে হয়
তােমারে তােমার রূপ ধরিতে পারে না
আর, তাই সদা কাঁপিতেছে টলমল

করি\’। নিত্যদীপ্ত হাসিটির মাঝে
ভরা অশ্রু করিতেছে বাস, মাঝে মাঝে
ছলছল করে\’ ওঠে, মুহূর্ত্তের মাঝে
ফাটিয়া পড়িবে যেন আবরণ টুটি\’।
সাধকের কাছে, প্রথমেতে ভ্রান্তি আসে
মনােহর মায়াকায়া ধরি’; তা\’র পরে
সত্য দেখা দেয়, ভূষণ-বিহীনরূপে
আলাে করি’ অন্তর বাহির। সেই সত্য
কোথা আছে তােমার মাঝারে, দাও তা\’রে।
আমার যে সত্য তাই লও। শ্রান্তিহীন
সে মিলন চিরদিবসের। অশ্রু কেন
প্রিয়ে? বাহুতে লুকায়ে মুখ কেন এই
ব্যাকুলতা? বেদনা দিয়েছি প্রিয়তমে?
তবে থাক, তবে থাক্। ওই মনােহর
রূপ পুণ্যফল মাের। এই যে সঙ্গীত
শােনা যায় মাঝে মাঝে বসন্তসমীরে
এ যৌবন যমুনার পরপার হ\’তে,
এই মাের বহুভাগ্য। এ বেদনা মাের
সুখের অধিক সুখ, আশার অধিক
আশা, হৃদয়ের চেয়ে বড়, তাই তা\’রে
হৃদয়ের ব্যথা বলে\’ মনে হয় প্রিয়ে।

পরে পড়বো
৯৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন