আমার হেঁটে যাওয়া পথে একটা মাটির ঢেলা আচমকা পা মচকে দিয়ে বলল, ‘তোমার চোখ চায় না তুমি এই পথে হাঁটো। তাইতো সে ইচ্ছে করেই আমায় দেখল না। কেমন বেখাপ্পা পা ফেলল আমার ওপর’।
আমি চোখকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘আমি না, তোমার পা। সে আর এগুতে চায় না সামনে। বড্ড ক্লান্ত সে। তার খানিক বিশ্রাম চাই।’
আমি খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়লাম মাটির রাস্তার পাশের সবুজ দূর্বা ঘাসে।
ঘাসের ভেতর থেকে সুচের ডগার মতন ধারালো, তীক্ষ্ণ কিছু ঘাসের ডগা আমায় খুঁচিয়ে দিয়ে বলল, ‘লম্বা পথ হাঁটতে হলে শরীরে তাগদ থাকতে হয়। যেখানে সেখানে এমন বসে পড়া দুর্বলতা। এমন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি নিয়ে বহুদূর পথ হেঁটে যাওয়া যায় না।’
আমি দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর হেঁটে চললাম বহুদূর পথে। ওখানে দিগন্তে এসে আকাশ নেমেছে। মেঘেরা হয়েছে সোনালি আর বৃষ্টিরা সব আদুরে স্পর্শ।
আমি পা ফেলতেই একটা সাপ ফোঁস করে ফণা তুলে বলল, ‘এ পথে আমাকে মাড়িয়ে যেতে নেই। দংশন আর বিষে তোমায় নীল করব।’
আমি বললাম, ‘আমি তোমায় মাড়িয়ে দেব না। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাই। তুমি আমায় দংশন করবে কেন? তোমার সাথেতো আমার কোনো বিদ্বেষ নেই, বিরোধ নেই।’
সাপ খানিক চুপ করে থেকে বলল, কেউ আমায় পার হয়ে গেলে আমার খুব ঈর্ষা হয়।’
আমি বললাম, ‘কেন?’
সে বলল, ‘তোমার সামনের ওই বরফ শীতল পথ পেরিয়ে বহুদূরের সেই আকাশ মিশে যাওয়া দিগন্ত, সোনালি মেঘ আর ঈষদুষ্ণ আদুরে বৃষ্টির দেশে আমি যেতে পারি না বলে!’
আমি বললাম, ‘আমাকে যেতে দাও। হয়তো আমার মতো কেউ না কেউ গিয়েই একদিন বরফ শীতল পথটাকে তোমার জন্য করে তুলবে উষ্ণ আর আরামদায়ক!’
সাপটা গভীর তন্ময়তায় কিছু ভাবছিল। আমি পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সামনে। সেখানে অপেক্ষায় ছিল প্রকাণ্ড খাদ। আমি বললাম, তুমি এমন রাক্ষুসে হা করে আছো কেন?
সে বলল, ‘আমার বুকের ভেতর এক বিশাল পাথর। সেও চেয়েছিল গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে ওই সোনালি মেঘের দিগন্ত ছুঁতে। কিন্তু পারেনি। খানিক অসাবধানতায় ধ্বসে পড়েছে ফাঁপা মাটি। সে আটকে গেছে আমার বুকের ভেতর।’
আমি বললাম, ‘একদিন কেউ একজন পাথরটাকে তোমার বুকের ভেতর থেকে তুলে ওই দিগন্তে নিয়ে যাবেই। তুমি কী খানিক তোমার রাক্ষুসে হাঁ খানা বন্ধ করবে?’
খাদের ভেতর থেকে শক্ত পাথরটা তখন ছড়াচ্ছিল ক্রোধ আর ঘৃণার বিষবাষ্প। আমার মচকে যাওয়া পা, দ্বিধান্বিত চোখ আমায় বলল, ‘চলো, ফিরে যাই। এ বড় শ্বাপদসঙ্কুল পথ। এখানে পদে পদে ঘৃণা আর বিদ্বেষের ছড়াছড়ি।’
আমি বললাম, কাউকে না কাউকে সেই ঘৃণা জয় করতেই হবে, বিদ্বেষ আর বিবাদের বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে হবে ভালোবাসার সৌরভ। তারপর এগিয়ে। যেতে হবে সোনালি মেঘ আর আদুরে বৃষ্টির দেশে।
আমি খাদ পেড়িয়ে চলে এলাম শুকনো মরুর দেশে। প্রবল তেষ্টায় পুড়ে যাওয়া গলার ভেতর থেকে চিৎকার করে জল চাইছিল আমার কণ্ঠনালি। আমি বললাম, আর খানিক অপেক্ষায় থাকো, এইতো খানিক। তারপরই বসন্তের দেশ। সেখানে জল আছে, ঝরনা ও নদী আছে। আছে ফুল ও ফসল।
কিন্তু আমার হাত ক্লান্ত, আমার পা ক্ষতবিক্ষত, আমার চোখ আগুনে ঝলসে ঝাপসা। তারা সব ‘অসহযোগ’ ডেকে আমায় বলল, থামো। এই পথ এখানেই শেষ। এখানে, এই নির্জন মরুভূমিতেই তোমার মৃত্যু। তোমার স্বপ্নের সমাধি।
কিন্তু আমার মন বলল, আর মাত্র দু কদম পথ, তারপরই সুললিত ঝরনা, তারপরই হাওয়া, তারপরই নদী, তারপরই পাখি, তারপরই আকাশ ছুঁয়ে গেছে। দিগন্ত, সোনালি মেঘ দলবেঁধে এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, আমায় ছুঁয়ে দাও। তারপর ছুটে যাও পেছনে ফেলে আসা অজস্র ঈর্ষা আর দ্বেষ, হিংসা আর বিভেদ, সংশয় আর পরর্শিকাতর আত্মাদের কাছে। তারপর তাদের বুকের ভেতর ছড়িয়ে দাও ভালোবাসার আতর। তারা সুবাসিত হোক প্রেমে ও শ্রমে, বোধে ও বন্ধুত্বে।
আমি যখন দিগন্তের শেষ সীমায় দাঁড়ালাম, তখন সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে, সোনালি মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে চুলের ডগা। চাইলেই আকাশটাকে ছুঁয়ে দেয়া যাচ্ছে হাতের তালুর স্পর্শে। তখন আকাশ, তখন সোনালি মেঘ, তখন আদুরে বৃষ্টি আমায় বলল, তুমি পেরেছ।
আমি ঘোরগ্রস্ত গলায় বললাম ‘আমি পেরেছি?’
তারা বলল, ‘হ্যাঁ, পেরেছ।’
আমি আমার পায়ের দিকে তাকালাম, আমার হাত, হাঁটু, শরীর, এমনকি ঝরনার জলে দেখে নিলাম চোখকেও।
কী অসহ্য শ্রমে আর ঘামে তারা আমায় নিয়ে এসেছে স্বপ্নের বহুদূর দিগন্তে।
কিন্তু সোনালি মেঘ এসে আমায় ফিসফিস করে বলল, ‘এরা কেউ তোমায় নিয়ে আসেনি। তোমায় যে নিয়ে এসেছে, তার নাম মন। তার নাম সংকল্প। জগতের সবচেয়ে পেশিবহুল বাহু, দৃঢ়তম হাত, ইস্পাতের কঠিন পা, কিংবা বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখও এ পথে আসতে পারেনি। এইসব ঝঞ্ঝা, এইসব ক্রোধ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা কিংবা এই বিভীষণ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে। কারণ, তাদের বুকের ভেতর এমন প্রাণ ও প্রতিজ্ঞা ছিল না। এমন মন ও মানুষ ছিল না।’
আমি তখনও দাঁড়িয়ে আছি। আমার বুকের ভেতর তখন বয়ে যাচ্ছে পুষ্পগন্ধা নদী, সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির দল। আমি তাদের আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে বললাম, মানুষের এমন মন থাকলে আমরা ছুঁয়ে দেব ভালোবাসার আকাশ, মমতার সোনালি মেঘ, আর ভিজে যাবো আদুরে স্নেহের বৃষ্টিতে। আমরা ভিজবোই। আমরা ভাসবোই।
তোমরা এসো।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন