অধিকার
শংকর ব্রহ্ম
এসব অনেক দিন আগেকার কথা। সেসময় অনন্তপুরের রাজার দরবারে পণ্ডিত ব্যক্তির কোন অভাব ছিল না। তাই একদিন রাজার খুব ইচ্ছে হল, তাঁর রাজ-দরবারে কোন একজন মূর্খব্যক্তির উপস্থিতি দরকার। যার মুর্খামীর কাজকর্ম দেখে কিংবা তার কথা শুনে সভাসদেরা প্রত্যেকে মজা পাবে। তাই তিনি রাজ্যে এই নিয়ে এক প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছেন জানিয়ে, ঘোষকদের দিয়ে সেটা তার রাজ্যের সর্বত্র ঘোষণা করে দিলেন। তাঁর রাজ সভায় একজন সর্বাধিক মূর্খব্যক্তির জন্য আসন বরাদ্ধ করা হয়েছে। তার মাসিক মাসোহারা পন্ডিতদের মতো উচ্চহারে নির্ধারিত করা হবে। তার জন্য তাকে প্রতিযেগিতায় অংশ গ্রহণ করে প্রমাণ করতে হবে সকলের কাছে, যে তিনি একজন সর্বাধিক মূর্খব্যক্তি।
সেই প্রতিযোগিতার রাজ্যের অনেক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছিল। রাজা অশংগ্রহণকারী সংখ্যটা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমার রাজ্যে এতজন মূর্খব্যক্তি আছে, কই, আগে তো কখনও জানা ছিল না ! সে যাই হোক, সেই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তিনি একজন সর্বাধিক মহামূর্খব্যক্তিকে বেছে নিলেন। সেই মহামূর্খ দেখতে বেশ অদ্ভুত ধরনের। চোখদু’টি কাঁচের মার্বেলের মতো গোল গোল। মুখটা লম্বাটে, গাধার মতো ভাবলেশহীন। কানদু’টিও গাধার মতো লম্বা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে। চিবুকে ছাগলের মতো কয়েক-গোছা দাঁড়ি। মাথার চুলগুলি সজারুর কাঁটার মতো খাড়া খাড়া ।
সেই মুর্খের জন্য এক বিশেষ ধরনের মুকুটের ব্যবস্থা করা হল। মুকুট না বলে রাজা তাকে ‘টুপি’ বলে অভিহিত করলেন। রাজা তার নাম দিলেন ‘গাধার-টুপি’। সেটা পরান হল তাকে।
রোজ সে সকলের সঙ্গে সময় মতো রাজা দরবারে এসে বসতো। সভাশেষে সেই মূর্খকে রাজা একটা করে প্রশ্ন করে আর তার মজার উত্তর শুনে দরবারে সবাই হো হো হেসে ওঠেন। তা দেখে রাজা খুব আনন্দ উপভোগ করেন। এইভাবেই আনন্দ ও মজায় তাঁর দিনগুলি বেশ কেটে যাচ্ছিল।
কিন্তু, কথায় বলে, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ ঠিক তাই হল রাজার।
একদিন সেই রাজা হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে তাঁর অসুস্থতা বেড়ে চলল। অনেক হাকিম বৈদ্য দেখিয়েও, কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা গেল না। সবশেষে সকলেই তারা হার মেনে নিয়ে বিদায় নিলেন । শহর থেকে বড় ডাক্তার আনা হল রাজার জন্য। রাজার শরীরের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই ডাক্তারবাবু জানলেন, রাজা হয়তো আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন না, কারণ তাঁর মাল্টি অর্গান ফাংশন করতে ফেল করছে বারবার।
রাজার মনে খুব ইচ্ছা ছিল সে তাঁর শেষ জীবন টা হাসতে হাসতে কাটাবেন । তাই রাজা সেসময় এক নিভৃতে-কক্ষে সেই মূর্খকে ডেকে পাঠালেন। রাজার ডাক পেয়ে সেই মূর্খ এসে হাজির হল রাজার নিভৃতকক্ষে। মূর্খকে দেখে রাজা খুব খুশি হয়ে বললেন, আয় আয় বস এখানে, আমার পাশে।
মহামূর্খ কিছুটা ইতস্ততঃ করে সেখানে বসার পর রাজা তাকে বললেন, এতদিন তো আমি তোকে সব প্রশ্ন করেছি। আর তুই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিস। আজ তুই আমাকে প্রশ্ন কর, আজ আমি তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
মহামূর্খ বলল, রাজামশাই শুনলাম সবাই বলাবলি করছে আপনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। তবে মরার পরে আপনি কোথায় যাবেন? রাজা তার কথা শুনে উদাস হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ, তারপর মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন, আমার মালিক পরমাত্মার কাছে ।
মূর্খ তা শুনে, আবার প্রশ্ন করল, রাজামশাই আপনি সেখানে গিয়ে কতদিন থাকবেন?
রাজা বললেন, সারাজীবন।
মূর্খ এবার বলল, তাহলে তো আপনি আর আমাদের এখানে ফিরবেন না নিশ্চয়ই?
– না, আর কোনদিনই এখানে ফেরা হবে না আমার।
– তাহলে তো আপনি সেখানকার জন্য অনেক কিছুর বিধি-ব্যাবস্থা করে রেখেছেন আগে থেকে, যাতে আপনার সেখানে গিয়ে কোন রকম অসুবিধা কিংবা অভাব না হয়?
রাজা এই কথা শুনে চিন্তায় পরে গেলেন। কোন কথাই বলতে পারলেন না তার উত্তরে। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াতে লাগল।
তা দেখে মহামূর্খ বলল, আপনি কাঁদছেন কেন রাজামশাই?
– না রে, সেখানের জন্য আমার কোন বিধি-ব্যবস্থাই করা হয়নি।
– যেখানে চিরদিন থাকবেন, সেখানকার জন্য, কেন কোন রকম বিধি ব্যবস্থা করেননি আপনি? আর যেখানে থাকবেন না চিরদিন, সেখানকার জন্য এত বড় রাজ্যপাট আর সব সুখ-বিলাসের ব্যবস্থা, আর যেখানে সারা জীবন থাকবেন সেখানের জন্য কিছুই না? তাহলে তো দেখছি, আমার চেয়েও আপনি মহামূর্খ। তাই এই টুপি আর এখন আমার মাথায় শোভা পায় না।
বলে মহামূর্খ, নিজের মাথার সেই টুপি খুলে রাজার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আমাকে মার্জনা করবেন মহারাজ, এই মুকুটের উপর এখন দেখছি, আমার চেয়েও আপনার অধিকার বেশি।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন