শংকর ব্রহ্ম

গল্প - গল্প হলেও সত্যি – দ্বিতীয় পর্ব

লেখক: শংকর ব্রহ্ম
প্রকাশ - মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ধরণ: জীবনবাদী

গল্প হলেও সত্যি – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

ঘুগনি বিক্রেতা থেকে জাতীয় কবি
(হরধর নাগ)
শংকর ব্রহ্ম

ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া এই ঘুগনি বিক্রেতাকে নিয়ে পি.এইচ.ডি করছেন ৫ জন। জেনে নিন তবে, কে ইনি?

৩১শে মার্চ ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দে উড়িষ্যার বরগড় জেলার ঘেস গ্রামে একটি হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই মানুষটি। দশ বছর বয়সে যখন বাবা মারা যান, কৃতকার্য হয়েই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয় তাকে।
অভাবের তাড়নায় পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে সেই ঘেস গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাঁধুনি হিসেবে তাঁর জীবনসংগ্রাম শুরু করেন।

“প্রেমের পরশে সবাই কবি হয়ে ওঠে।” – (প্লেটো)

এই কাজের সময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় মালতী নামের একটি মেয়ের । যিনি সেই হোস্টেলেই রান্নার কাজে সাহায্য করতেন। ধীরে ধীরে মালতীকে ভালবাসতে শুরু করেন তিনি। মালতি বেশ সুন্দরী হওয়ায় মুখে ভালবাসার কথা বলতে না পারলেও রান্নাঘরের দেওয়ালে কয়লা দিয়ে কবিতা লিখে মালতীকে ভালবাসার কথা বোঝাতে চাইতেন তিনি। রান্না ঘরের দেওয়াল ভরে উঠত এমন শত শত কবিতায়। শেষে এই লাজুক প্রেমিকটির মনের গভীরতা ভাল লেগে যায় মালতীর ; বিয়েও করেন। সংসার বড় হয়। আসে তাদের ভালবাসার প্রাপ্তি- মেয়ে নন্দিনী ।
পরবর্তীতে মিষ্টির দোকানে বাসন ধোয়া থেকে রাস্তায় ঘুগনি বিক্রি করা, এমন সব অনেক কাজই জীবনে করতে হয়েছে তাকে। গোটা জীবনটাই কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের পরামর্শেই বিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারের পাশে একটি ছোট্ট বই-খাতার দোকান খোলেন তিনি। ছেড়ে দেন রান্নার কাজ।
এই প্রথম কলম হাতে ওঠে তার। আর সাদা পৃষ্ঠার অভাব ছিল না দোকানে। শুরু হয় পুরোদমে কবিতা লেখা। ছোটবেলা থেকেই কোসলি ভাষায় ছোটগল্প লেখা শুরু করেন তিনি। কবিতা চর্চা শুরু করেন একটু বড় হয়ে। ১৯৯০ সালে প্রথম লেখা কবিতা ‘ধোদো বরগাছ’ অর্থাৎ বুড়ো বটগাছ স্থানীয় এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ তারপর তিনি আরও চারটি কবিতা পাঠান ঐ পত্রিকায়। সেগুলোও প্রকাশিত হয় একে একে।
কোশলি ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যার কোন লিখিত রূপই ছিল না। তাকে তিনি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছিলেন। শুরুতেই তার প্রথম কবিতা “ধোদো বড়গাছ” (বুড়ো বটগাছ) প্রকাশ পায় ১৯৯০ সালে। পত্রিকার পক্ষ থেকে কিছু সম্মান-দক্ষিণা দিয়ে তাকে উৎসাহিত করা হয়। এরপর “ভাব”, “সুরুত” একে একে শত শত কবিতা প্রকাশ পায় তাঁর । লিখে ফেলেন কোশলি ভাষায় ‘আচিয়া’, ‘বাছার’, ‘মহাসতী উর্মিলা’, ‘তারা মন্দোদরী’, ‘শিরি সামালাই’, ‘প্রেম পইচান’, ‘বীর সুরেন্দ্র সাই’, ‘শান্ত কবি বিমাভাই’, ‘রুশি কবি গঙ্গাধর’ ইত্যাদি ২০ টি মহাকাব্য।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক লেখা প্রশংসা কুড়োয় সাধারণ মানুষ থেকে সাহিত্য সমালোচকদের। তাঁর সমস্ত কবিতা একত্রিত করে ‘হলধর গ্রন্থাবলী’ প্রকাশ করেছে সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়। চলছে এই বই এর দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতিও।
ভারতের ইতিহাসের ১৬ জনপদের একটি কোশল রাজ্যের ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন উৎকৃষ্ট মহাকাব্য আর কেউ লেখেননি কোনও দিন। এই মানুষটির লেখা হাজার হাজার কবিতা কোশলি কাব্যসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ । কোশল প্রদেশের মানুষ তথা উড়িষ্যার মানুষ “কোশল কুইলি”, “যাদব কুলগৌরব”, “যাদবজ্যোতি” “কোশলরত্ন” ইত্যাদি নামে ভূষিত করেছে তাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর লেখা সব কবিতা তাঁর মুখস্থ। যেই কবিতাটা যখন শুনতে চান, তৎনই তিনি তা শুনিয়ে দেবেন।
পরনে সাদা ধুতি ও কুর্তা। পিঠ পর্যন্ত লম্বা তেল জবজবে চুল। পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। এমন চেহারার ঘুগনি বিক্রেতা স্বাভাবিকভাবেই কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে না৷ আর তাই অনেকেই জানেন না পর্যন্ত যে, এই অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন কাটানো মানুষটি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত জনপ্রিয় একজন কবি।
তাঁর প্রতিভা কখনও জীবনের অভাবের কাছে হার মানেনি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া হলধরের উপর ছিল মা সরস্বতীর আশীর্বাদ, তাই যতবারই তিনি কলম ধরেছেন তাঁর হাত থেকে ঝরে পড়েছে সাহিত্যের মণিমুক্তা।
২০১৪ সালে তিনি “উড়িষ্যা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার” পেয়েছেন । তার সেই বইখাতার দোকানটি এখন তার গুণমুগ্ধ স্কলারদের কাছে মন্দির স্বরূপ । উড়িষ্যা সরকার সংরক্ষণ করেছে সেটিকে।
এই অতি সাধারণ মানুষটি হলেন, হলধর নাগ।

সম্বলপুরী-কোশলি ভাষায় সাধারণ গ্রাম্য জীবনে মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা, ভালবাসার কথা, প্রতিবাদের কথা, অতীত গৌরবের কথা, ধর্মের কথা এত সুন্দর আঙ্গিকে এর আগে কেউই তুলে ধরতে পারেননি। তাঁর লেখার কৌশল একটি নতুন কাব্য ধারা তৈরি করে, যেটি তার নাম অনুযায়ী “হলধর ধারা” হিসেবে পরিচিত।

তাঁর কাব্যগুলি সঙ্কলিত করে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে “হলধর গ্রন্থাবলী” এবং “হলধর গ্রন্থাবলি- ০২”। এই বইগুলি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স সিলেবাসের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে।

লোক কবিরত্ন- হলধর নাগ ; আপনাকে এমন সম্মান দিয়ে ভারতবর্ষ গর্বিত।
এই মুহুর্তে তার লেখা নিয়ে গবেষণা করছেন পাঁচ জন গবেষক।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
২০১৯ সালে তিনি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় দেয় সাম্মানিক ডক্টরেট। প্রতিভা হল ছাই চাপা আগুন। তার প্রমাণ ‘লোক কবি রত্ন’ হলধর নাগ।
এখনও তিনি আগের মতই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন।

হলধর নাগের পাঁচটি কবিতা : –

১).

বীক্ষণ

অবিরাম ধান কেটেছি গত ঘুমে— কাস্তে ছিল ঘামের জোয়ার
অবিরাম মাছ ধরেছি গত ঘুমে— জাল ছিল নিশ্ছিদ্র তুষার
অবিরাম পুড়েছে জীবন গত ঘুমে— অসহ রাতের শরম
অবিরাম বীজ বুনেছি গত ঘুমে— মাটি ছিল নারীর নরম
অবিরাম হেঁটেছি শ্রমণ গত ঘুমে— মন ছিল মত্ত শ্রবণে
অবিরাম গেয়েছি গান গত ঘুমে— বেহুলার অশ্রু শ্রাবণে
আরো অবিরাম,অবিরাম কেটেছে প্রহর কত অনুভবে জেনে যাই আমি
তবু গানে ও গমনে বুঝি না জীবনে— চাষ করি কার জমি…

(দ্র.ব্য : কোশলি ভাষা থেকে অনূদিত বীক্ষণ কবিতাটি পরিবর্তন নিউজ (১৪ এপ্রিল ২০১৬ সাল) প্রকাশিত ; কিন্তু অনুবাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।)
কবিতা এই পাললিক অরন্যে (Poetry in this alluvial forest)

২).

অন্তরীণ মধুপের শিস

প্রভু, তাহলে মৃত্যু দাও— আত্মঘাতি উৎসবের মতো
কোকিলার স্নেহে পান করি উষ্ণতার শীত
প্রভু, নইলে সংরক্ষিত বাগানের ফুলে সেঁটে দাও
গোটা কয়েক শুদ্ধস্তন
আর বিজিত অধম ভেবে আমাকে প্রবেশাধিকার দাও
শপথ—সঙ্গলিপ্সায় কোনো দিন বনে বাজারে ঘুরবো না
প্রভু, অন্তত পাহাড়-প্রসূত প্রস্রবনে একটা বিয়ে দিও
যদি অতিরিক্ত আদরে মরে যাই
লোকদের ভাসিয়ে দিতে বলো—
আরক্ত গোলাপের স্রোতে

(দ্র.ব্য : কোশলি ভাষা থেকে অনূদিত বীক্ষণ কবিতাটি পরিবর্তন নিউজ (১৪ এপ্রিল ২০১৬ সাল) প্রকাশিত ; কিন্তু অনুবাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।)
কবিতা এই পাললিক অরন্যে (Poetry in this alluvial forest)

নীচের কবিতাগুলি
[ কোশলি ভাষা থেকে অনুবাদ : কৌশিক ভাদুড়ি ]

৩).

কোকিল

লুকিয়ে লুকিয়ে গান গাস রে কোকিল
আম বাগানের ঝোপে
(যেন) টুপটাপ পড়ে চাক ভেঙে রস
তাই শুনে পেট ভরে।।
পাখির ভেতর তুই রানি হোস
কন্ঠ বেড়ালের ঘণ্টা*
তোর বুলিটা নিখাদ মধুর
গলে মিশে যায় মনটায়।।
কাকের বাসাতে ডিম পেড়ে রেখে
নছড়ামি তোর ঘোর
ঝারা হাতপায়ে ট্যাংট্যাং ঘোরা
নেই সন্তান স্নেহ তোর।।
শুনেছি মালিকা যখন কৃষ্ণ
গেল কংসবধ দেখি
তার মা যশোদা শরণে কেশব
কেঁদেছিল তুই সাক্ষী।।
বছরে একবার আজ যে দশমী
পথে উল্টো রথের ঢল
শ্বশুর ভিটেতে খেটে মরা বধুর
সে খবরটাই সম্বল।।
গিরগিটি বয় কাপড়ের গাঁট
ফুল সাজি বয় ফিঙে
দুটো টুনটুনি যেন বউ দুটি
উলু দেয় তিতিরে।।
পাখির মিছিলে কাঠঠোকরা ঢাকী; মুহুরি অন্য পাখি
বিবাহের এই শোভাযাত্রায় ভাট পানকৌড়ি
ডালা সাজিয়ে বাজা বাজিয়ে গায়ে হলুদের তত্ত সাজিয়ে
ফলমূল আর খাজাগজা নিয়ে ময়না তাদের নেত্রী।।
দেখা দিস না রাগিণী শোনাস
লাজ করে গুণবতী
দেখা দেন না বিচক্ষণ সুজন
(দিলে) গুণ হয়ে যায় মাটি।।
* উল্টো রথের সময়ে শ্রাবণের শুরুতে কোকিলের ডাক ঘণ্টির মতো শোনায়।
হয়তো তারা ছানা কোকিল, কিংবা বড় কোকিলের শেষ মেটিংকল।

৪).

পাঁচ অমৃত

যেখান থেকে অমৃত ঝরে
সাত সমুদ্র থেকে
স্বর্গ থেকে
মায়ের স্তন থেকে
মহৎ নীতির ধারা থেকে
কবির কলম চালাই।।

৫).

উজ্জ্বল সলিতা

প্রদীপ জ্বাললে জীবন উজ্জ্বল
ঘুপচি ছাদের ঘরে
চাঁদকে জীবন্ত উজ্জ্বল দেখে
আঁধার পালায় ডরে।।
অজ্ঞানতার আঁধার ভিতরে
পাঁড় ছ্যাঁচোর রত্নাকর
জ্ঞানের উজ্জ্বলতা দেখে হয়ে গেল
বাল্মীকি মুনিবর।।
আঁধারের ঝারে যোগ্য ছেলেটি
দিয়েছে প্রদীপ জ্বালি
জ্বলা সলিতার মতো উজ্জ্বল
পশ্চিম উড়িষ্যার বুলি।।

১১৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন