অণুগল্প রূপকথা
রূপকথা
রুদ্রনাথ কর
°°°°°°°°°°°°°°°°
উড়িষ্যা তিগিরিয়া নিজিগড় রাজ্যের রাজা তখন ব্রজরাজ ক্ষত্রিয় বীরবর চমুপতি সিং মহাপাত্র। তাঁর অতুল আমোদ প্রমোদ ও বিলাস-ব্যসনে কাটতো। তাঁর সেবায় জন্য থাকতো ত্রিশ জন দাস-দাসী। তাঁর জন্য সদরে দাঁড়িয়ে থাকত পঁচিশটি বিলাসবহুল গাড়ি।
একদিন এক জেলে সমুদ্র থেকে একটি বড়সড় মাছ ধরে নিয়ে গেলো রাজ দরবারে। রাজামশাই চমুপতি সিং মাছটি দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি বড় মাছ খেতে খুব ভাল বাসতেন।। রাজামশাই খুশি হয়ে জেলেকে ৫০০ টাকা দিয়ে দিলেন। পাশেই বসে ছিলেন রাণী রসমঞ্জরী দেবী। তিনি ফিসফিস করে রাজাকে বললেন, এই সামান্য মাছটার দাম তুমি ৫০০ টাকা দিয়ে দিলে ! বড়জোর খুশি হয়ে তাকে ২০০ টাকা দিতে পারতে। মাছ নিয়ে টাকা ফেরত দিতে বল।
চমুপতি সিং শুনে বললেন, একী বল রাণী ! রাজারা যা বলে তা নড়চড় করা অসম্ভব, তাছাড়া এটাতো রাজাদের ইজ্জতের ব্যাপার ।
রসমঞ্জরী দেবী বললেন, আমি এমন একটা বুদ্ধি দিচ্ছি যা প্রয়োগ করলে তোমার সন্মানের কোন হানি হবে না। জেলেও মাছ ফেরত নিয়ে, টাকা ফেরত দিবে ।
চমুপতি সিং বললেন কি বুদ্ধি?
রসমঞ্জরী দেবী বললেন, জেলেকে ডেকে বলবে তোমার মাছটা কি পুরুষ না স্ত্রী? যদি জেলে বলে মাছ পুরুষ, তাহলে তুমি বলবে আমার স্ত্রী মাছ লাগবে আর যদি জেলে বলে মাছ স্ত্রী, তাহলে তুমি বলবে আমার পুরুষ মাছ লাগবে। জেলে তখন মাছ ফেরত নিয়ে, টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হবে।
রাণীর বুদ্ধিতে খুশি হয়ে, চমুপতি সিং জেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মাছটা কোন জাতের? পুরুষ না স্ত্রী? জেলে প্রথমটা থতমত খেয়ে, একটু ভেবে নিয়ে বললো, জাঁহাপনা আমার মাছটা পুরুষও না স্ত্রীও না ! আমার মাছটা হলো হিজড়া। এবার রাজদরবারে হাসির রোল পড়ে গেল, চমুপতি সিং নিজেও হাসলেন উচ্চস্বরে। রাণীও শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে হাসলেন নীরবে।
চমুপতি সিং জেলের বিচক্ষণতা ও প্রত্যুৎপন্নমতি বুদ্ধি দেখে খুশি হয়ে আরও ৫০০ টাকা বেশী দিয়ে দিলেন। জেলে তো খুব খুশি হয়ে মোট ১০০০ টাকার পোটলায় নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় রাজমহলের মেইন গেইটের সামনে যেতেই পোটলা থেকে পাঁচটি টাকার একটি কয়েন মাটিতে পড়ে গেল। জেলে তা নীচু হয়ে তুলে নিয়ে, কপালে ঠেকাচ্ছে আর চুমু খাচ্ছে।
এদিকে তা দেখে রাণী রসমঞ্জরী দেবী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে, রাজাকে বললেন, জাঁহাপনা আপনি দেখলেন, জেলে কী লোভী!
কেন কি হয়েছে? চমুপতি সিং জানতে চাইলেন।
রসমঞ্জরী দেবী বলরেন, ১০০০ টাকা থেকে মাত্র পাঁচটি টাকা নীচে পড়ে গেছে, জেলের তা সহ্য হচ্ছে না। আপনি তাঁকে শাস্তি দেন, এতো লোভ কেন তা?
রসমঞ্জরী দেবীর কথা শুনে, চমুপতি সিং ভাবলেন, হ্যাঁ, ঠিকই তো, মাত্র পাঁচটা টাকা পড়ে গেছে, গেট দিয়ে কত গরিব মানুষ আসা যাওয়া করে, তারা না হয় কুড়িয়ে নিতো।
চমুপতি সিং জেলেকে ডেকে বললেন, তুমি এতো লোভী কেন জেলে?
কেন মহারাজ? জেলে করজোড়ে জানতে চাইলো।
তোমার এত লোভ কেন? এত টাকা দিয়েছি তোমায়, মাত্র পাঁচ টাকার লোভ সামলাতে পারলে না? তা-ও তুলে নিয়ে তুমি চুমু খাচ্ছ? এত লোভের জন্য তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
জেলে বলল, জাঁহাপনা ! আমি কিন্তু লোভের কারণে ঐ টাকাটা তুলে চুমু খাইনি। টাকার গায়ে আমার রাজামশাই ও রাণীমা’র নাম লেখা আছে, ভাবলাম টাকাটা মাটিতে পড়ে থাকলে, হয়তো অন্য কোন মানুষ পা দিয়ে পিষবে আর আমার জাঁহাপনা ও রাণীমা’র ইজ্জতের হানি হবে। তাই ভেবে আমি টাকাটা তুলে নিয়ে চুমু খেলাম এবং কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম।
এবার চমুপতি সিং জেলের এ কথা শুনে, আরও খুশি হয়ে জেলেকে আরও ৫০০ টাকা দিলেন। সর্বমোট ১৫০০ টাকা নিয়ে জেলে বিদায় হলেন।
এরপর রাজা চমুপতি সিং ঘোষককে ডেকে বললেন, তুমি সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দাও, কেউ যেন তার বউয়ের বুদ্ধিতে না চলে।
আর এটাও বলে দাও সাবধান করে , বউয়ের বুদ্ধিতে চললে পাঁচশ টাকার জায়গায় ১৫০০ টাকা লোকসান দিতে হবে, জরিমানা হিসাবে।
পরদিন ঘোষক সারা রাজ্যে সেই কথাই ঘোষণা করে দিল।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন