শংকর ব্রহ্ম

গল্প - ঠিকানা সোনাগাজী

শংকর ব্রহ্ম
শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪ জীবনবাদী

ছোটগল্প ঠিকানা সোনাগাজী

ঠিকানা সোনাগাজী
শংকর ব্রহ্ম

আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়াটে হযে এলো মুন্না। পড়াশুনার বালাই নেই। পাড়ার মাস্তানি করে বেড়ায়।
আমার ওপরে তার মুন্নার কুনজর পড়ল।

সেদিন ছিল শিবরাত্রি। মা সারাদিন উপোস করে, বিকেলের দিকে কাছেই একটি শিব মন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালতে গেছে। আমার মাথা ধরেছে বলে ঘরে শুয়ে আছি।
হঠাৎ দেখলাম, দরজায় কার ছায়া পড়েছে। ভাবলাম, মা বােধহয় ফিরল। দেখলাম, না মা নয়, মুন্না এসে ঘরে ঢুকল।
তাকে দেখে আমি রুক্ষ স্বরে বললাম, কি চাই?
– তোমাকে
– এখনই বের হও ঘর থেকে।
শুনে সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাকে জড়িয়ে ধরে, জোর করে বিছানায় ফেলে, ঘটনার আকম্মিকতায় আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। তবু আমি বললাম, আমি কিন্তু চিৎকার করব। চেচিয়ে লোক ডাকব।
– ডাকো, আমিও বলব , তুমি আমাকে ঘরে ডেকেছো।
আমি চিৎকার করতে যেতেই সে জোর করে আমার মুখ চেপে ধরল। সে তার যৌন চাহিদা পূরণ করে একটু পরেই চলে গেল।
মা বাবার কাছে বলতে পারলাম না ভয়ে। নিজেকে অসহায় লাগছিল, ভাবছিলাম কাল মুখ দেখাবে কেমন করে ?
মুন্নাকে দেখলেই বুকটা কেঁপে উঠত ভয়ে-শঙ্কায়, আতঙ্কে, ঘৃণায়।
এরপর সুযোগ পেলেই মুন্না ঘরে আসত।
মনে মনে অনেকবার ভবেছি , ফুঁসে উঠবাে। কিন্তু পারিনি। ভেবেছিলাম গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ব। শেষপর্যন্ত মরতেও সাহসে কুলায় নি।
পঙ্কিল হয়ে উঠল আমার জীবন। শেষপর্যন্ত একদিন সব কিছু জানাজানি হয়ে গেল।
আমাদের ঘরে ঢুকে মুন্না সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে …। মা কি কাজে পাশের বাড়ি গেছিল। ঠিক সেই সময় ঘরে এসে ঢুকল। সে, তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে, মায়ের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি বিমূঢ়ভাবে বিছানায় পড়ে রইলাম। মা সেই মুহুর্তে আমার ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মা ফিসফিস্ করে তাকে কি সব বললেন। শুনে বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা শক্ত লাঠি দিয়ে আমাকে সমানে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলেন। মারতে মারতে লাঠিটা ভেঙে গেল। ভাবলাম এবার হয়তো মুন্নার হাত থেকে মুক্তি পাবো।
পরের দিন বাবা তাকে দেখতে পেয়েও কিন্তু কিছু বললেন না। শুধু আমাকে শাসিয়ে ওকে শুনিয়ে বললেন, আর একবার যদি ছেলেটা
এ ঘরে আসে, আমাকে বলিস, সেদিন ওর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।
তারপর দিন বাবা ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে, আমাকে বললেন বাড়িতে কেউ না থাকার ভান করে বিছানায় পড়ে থাকতে। মাকে পাশের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মুন্না টোপ গিলল। পা টিপে টিপে ঘরে এসে ঢুকল আমার।
বাবা ওকে মারার জন্য দরজার মােটা খিলটা খুলে নিলেন হাতে। বাড়ি মারতে যাবেন ওর মাথায়, এমন সময় মুন্না বাবার হাত চেপে ধরে বললে, খবরদার বলছি। লাঠির একটাও ঘা যদি আমার গায়ে লাগে, তাহলে …।
তাহলে কি করবে তুমি ? বাবা বললেন অগ্নিশর্মা হয়ে।
– হাটে হাঁড়ি ভাঙব। ঢি ঢি পড়ে যাবে আপনার মেয়ের নামে।
– তার আগে, আমি তােমাকে মেরে থানায়, পুলিশে দেবে।
– ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই দেখুন আপনার মেয়ের হাতের লেখা চিঠি।
বাবা চট্ করে ওর হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন।
মুনা, শ্লেষের হাসি হেসে বললো, ও রকম চিঠি আরও আছে।

– এ কথা সত্যি? বাবা রাগত স্বরে আমার কাছে জানতে চাইলেন। আমি চুপ করে রইলাম।
মুন্নাকে বাড়িতে না আসার জন্য মিনতি করে দু’একবার চিঠি লিখে ছিলাম, এ কথা মিথ্যে নয়।
তারপর আর কোন কথা নেই। বাবা মুন্নার দিক থেকে ঘুরে, আমার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে, আমাকে মারতে শুরু করলেন।
হঠাৎ কি হল, মুন্না বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ওকে আর মারলে, আপনাকে আমি খুন করে ফেলব। বলে মুন্না বাবার গলা টিপে ধরল। মুহুর্তে বাবার মুখের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠে গেল।
চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল। বিবর্ণ মুখে, বাবা ছটফট করতে লাগলেন। আমি তখন মুন্নাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।

এরপর দিনে, রাতে যখন খুশি আসতা। ওকে দেখেও বাবা না দেখার ভান করে থাকত। মুন্নাকে আগের মতো আর আমার অতাে খারাপ লাগত না। ধরেই নিয়েছিলাম, এটাই আমার ভবিতব্য।

এরপর থেকেই বাবা-মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। ওদের চোখে ঘুম নেই, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই। বাবার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল।
অনেক চেষ্টা করে বাবা মা, বরপণের অস্বাভাবিক লোভ দেখিয়ে (যা বাবার পক্ষে দেওয়া কোনদিনই সম্ভব নয়), একজন লোভী ছিট কাপড়ের দোকানের কর্মচারীকে পাওয়া গেল। সম্প্রতি যার বউ গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মারা গেছে। বাবা মা তাতেই রাজী হয়ে গেল। কথাবার্তা শুরু হলো। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল।
এরকম আত্মাহূতিতে আমার কোন সম্মতি ছিল না। মুন্নাকে আমি সব খুলে বললাম। পরদিন সে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে উঠল বেহালার এক বস্তিতে। কয়েকমাস বেশ ভালই কাটল আমাদের। নতুন জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলাম। মুন্নাও বােধহয় আমাকে সত্যিকারের ভালবেসে ফেলেছিল। তখন ওর প্রতি আমার মনে আর কোনও ক্ষোভ বা গ্লানি ছিল না।

হঠাৎ একদিন খবর এলো, পোর্ট এলাকায় স্মাগলিং করতে গিয়ে এনকাউন্টারে মারা গেছে মুন্না। সেখানে গিয়ে দেহ শনাক্ত করে আসতে হয়েছিল আমাকে। এরপর, কি করব, কিভাবে বাঁচব ভাবতে পারলাম না।
বুকে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে গেলাম বাবা মায়ের কাছে। সেখানেও আমার ঠাঁই হল না। ফিরে আসতে হয়েছিল বেহালার বস্তিতে।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এখন আমার ঠিকানা হল, বটতলার সোনাগাজী।

৭১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন