রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে
আমি আজও আলমারির ভেতর খুঁজি
একটা পুরোনো মলিন চাদর,
যেন সে এলে
ঠান্ডা না লাগে।
বাড়িটার প্রতিটি দেয়ালেই
তোমার অনুপস্থিতির ক্যালেন্ডার ঝোলে;
তারিখ নেই,
শুধু কিছু কালো দাগ
এবং মুছে না যাওয়া কালি-অশ্রু।
বারান্দার রেলিংয়ে
আজও ঝুলে আছে তোমার শব্দহীন হ্যাংগার;
ওখানে একদা শুয়ে থাকা শাড়ির ভাঁজে
অথবা পাঞ্জাবির কলারে
নাকি গলার কাছে গুঁজে রাখা আতরের গন্ধে
আমি এখনো শুনি—
অজানা কোনো শহীদ মিনারের সামনে
কারও নীরব দাঁড়িয়ে থাকা।
রান্নাঘরে ভোর হলে
দু’কাপ চায়ের বদলে আমি জল ফুটাই একাই—
বাষ্পের ভাঁজে তুমি উঠে আসো
অর্ধেক আঁকা ছবির মতো;
একটু পরেই মিলিয়ে যাও
চুলার আগুন নিভে গেলে
সব হিসেবের মতন।
ডাইনিং টেবিলের এক কোণে
তোমার জন্য রাখা প্লেটটা
এখন ভাঙা চাঁদের মতো—
তবু আমরা কেউ ছুঁই না;
ভাঙা জিনিসের ভেতরেই
সবচেয়ে বেশি অক্ষত থাকে স্মৃতি।
ড্রইংরুমের ঘড়িটা
তোমার মৃত্যুর রাতেই থেমে গেছে;
আমরা ঠিক করেছিলাম মেরামত করব,
কিন্তু পরে বুঝলাম
সময় আবার চললে
তুমি সত্যিই চলে যাবে।
এভাবে থেমে থাকা মিনিট-কাঁটাগুলোতে
আমরা তোমাকে আটকে রেখেছি
নিষ্ঠুর ভালোবাসার কারাগারে।
শিশুরা স্কুলে যায় সকালে,
ফেরার পথে
তারা আজও দরজায় ঢোকার আগে
জুতো খুলে সোজা তোমার ঘরের সামনে দাঁড়ায়;
ওরা ভাবে
দরজাটা খুললেই তুমি বসে থাকবে
হাতের মধ্যে খবরের কাগজ
চোখের ভাঁজে ভোরের পাখির ডানা।
আমরা কেউ ওদের বলতে পারিনি,
মৃত্যু বলে কিছু আছে—
যেখানে কেউ চিঠি পাঠায় না,
কেউ মেসেজও পড়ে না,
কেবল নীরবতার নীল ব্যাগে
হাওয়া এসে জমা রাখে
পুরোনো সব দীর্ঘশ্বাস।
রাতে বিদ্যুৎ গেলে
তোমার বিছানার পাশে আমরা এখনো
হারিকেন জ্বালাই;
যেন অন্ধকার নামলেও
তুমি যেন গা ছমছম ভাবো না—
মৃতেরা কি ভয় পায়?
এই প্রশ্নের উত্তর কোনো ধর্মগ্রন্থে নেই;
শুধু আমাদের ভীরু বুকেই লেখা থাকে
অদৃশ্য হরফে।
আমার মা বলেন,
তুমি নাকি স্বপ্নে এসে
তার সাদা চুলে হাত বুলিয়ে গেছ;
বাবা কিছু বলেন না,
তিনি শুধু ভোরবেলা আযানের পর
তোমার নাম ধরে ফিসফিস করেন—
যেন কোনো অনুবাদহীন ভাষায়
তোমাকে আবার ডেকে ফিরিয়ে আনছেন।
আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়
তুমি দূরের কোনো স্টেশনে বসে আছো,
টিকিট কেটে রেখেছ ফিরে আসার;
কিন্তু ঘোষণাটি বারবার পিছিয়ে যায়—
“ট্রেনটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত।”
মৃত্যুও যেন এক ধরনের প্ল্যাটফর্ম,
যেখানে সব যাত্রীর গন্তব্য এক
কিন্তু কারও হাতে নেই রিটার্ন টিকিট।
তোমার আলমারিতে আজও
গোছানো থাকে ধুতি, শাড়ি, পাঞ্জাবি;
আমি মাঝে মাঝে আলমারি খুলে
একটু ভেতরের হাওয়া নিই;
সেখানে জমে থাকা ধূলিকণাগুলো
আসলে ভেঙে যাওয়া দিনগুলোর অক্ষর—
যেগুলো আমরা কখনও উচ্চারণ করিনি।
একদিন পুরোনো ট্রাঙ্ক খুলতে গিয়ে পেলাম
তোমার হাতের লেখা একটা খাতা;
সেখানে অসমাপ্ত কয়েকটা কবিতার পাশে
অদ্ভুতভাবে ফাঁকা রেখেছ কয়েক পৃষ্ঠা—
হয়তো ভেবেছিলে
তোমার পরের দিনগুলো আমরা লিখব;
আমরা লিখিনি,
শুধু চোখের পানিকে কালি বানিয়ে
প্রতিটি সাদা পাতায় রেখে গেছি
অদৃশ্য স্বাক্ষর।
এ বাড়িতে এখন উৎসব মানে
দু’টো তালা কমে যাওয়া আলমারি,
আরও কিছু অপ্রয়োজনীয় কাপড়
দরিদ্রের ঘরে পৌঁছে দেওয়া;
কিন্তু যখনই আমি তোমার ব্যবহৃত
একটা সামান্য রুমালও
কাউকে দিতে যাই,
আমার বুকের ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করে ওঠে—
“নিজেকে কি সহজেই দিতে পারি অন্যের হাতে?”
এভাবেই আস্তে আস্তে শিখে গেছি,
মানুষ মরে যায় একদিন
কিন্তু তার ব্যবহার করা ছোট ছোট জিনিসগুলো
আমাদের ভেতরে বেঁচে থাকে
অমর সাক্ষীর মতো;
এক একটা মগ,
এক জোড়া পুরোনো স্যান্ডেল,
একটা ভাঙা চশমা—
সবাই মিলে সাজিয়ে রাখে
‘অনুপস্থিতির বাড়ি’।
রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে
আমি একা বসে থাকি বারান্দায়;
হাওয়া এলে মনে হয়
তুমি ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছ—
কাঁধের ওপর সাদা গামছা,
হালকা কাশির শব্দ,
আর পায়ের নিচে চটি স্যান্ডেলের টুপটাপ আওয়াজ।
আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি,
তুমি এসে দাঁড়িয়েছ দরজার কাছে;
আমি দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে বলেছি—
“এত দেরি কেন?”
কিন্তু চোখ খুলে দেখি
দরজাটা আধখোলা,
কোনো পায়ের শব্দ নেই,
শুধু দূরের মসজিদ থেকে
শেষ রাতের তাহাজ্জুদের আর্ত ধ্বনি ভেসে আসে।
হয়তো এভাবেই শিখে নিতে হয়,
তুমি আর ফিরে আসবে না;
তবু তোমার জন্যই
আমরা নিয়মিত ঝাড়ু দিই ঘরের মেঝেতে,
পরিষ্কার করি ধুলো জমা ক্যালেন্ডার,
টাঙিয়ে রাখি নতুন পর্দা—
যাতে তোমার অনুপস্থিতিও
কখনো পুরোনো না হয়ে যায়।
এ বাড়ির প্রতিটি কোণ তাই এখন
একেকটা অদৃশ্য কবরের মতো—
যেখানে আমরা দাফন করেছি
অগণিত অসমাপ্ত কথা,
অসংখ্য না-বলা ধন্যবাদ,
অপরাধবোধে ডুবে থাকা ক্ষমা প্রার্থনা।
তুমি চলে গিয়েছ অনেক দূরে,
কিন্তু এই বাড়ি
তোমাকে এখনো ছাড়েনি;
প্রতিটি দরজার কবজিতে
তোমার হাতের আলগা ছোঁয়ার শব্দ গেঁথে আছে,
প্রতিটি জানলার কাঁচে
তোমার শ্বাসের ধোঁয়া শুকিয়ে গিয়ে
দাগ হয়ে রয়েছে।
আমরা শুধু শিখে নিয়েছি
তোমাকে আর ডাকব না জোরে জোরে—
কারণ যাদের কোনো ঠিকানা নেই
তাদের নামে চিঠি লেখা যায় না;
তবু রাতে বিছানায় শুয়ে
চুপি চুপি বলে উঠি,
“আজ খুব ক্লান্ত লাগছে, তুমি পাশে থাকলে ভালো হতো…”
উত্তরে কোনো শব্দ আসে না,
কিন্তু বাতাস হালকা ঠান্ডা হয়ে যায়;
মনে হয় কেউ যেন
বুকের ওপর বাড়তি একটা চাদর টেনে দিয়েছে।
হয়তো এটাই
মৃতদের নিঃশব্দ সহানুভূতি;
হয়তো এভাবেই
অনুপস্থিতির বাড়ির প্রতিটি ইট
ধীরে ধীরে আলোয় ভরে ওঠে।
আমি জানি,
যেদিন আমি নিজেও
এই বাড়ির আরেকটা ঘরে
তোমার মতো অদৃশ্য হয়ে থাকব,
সেদিন আমার জন্যও কেউ
এভাবেই রাখবে অতিরিক্ত এক কাপ চা,
অর্ধেক ভাত,
একটি ভাঙা চশমা,
আর বুকভরা না-বলা কথা।
কিন্তু এই সব দৃশ্য, সব মানুষ,
সব সম্পর্ক আর সব অনুপস্থিতি—
আসলে আজও কেবল আমার কল্পনার আঁকা;
আমি এখনো কোনো বাড়ির স্বামী নই,
কোনো সন্তানের বাবা নই,
কোনো বিধবার নীরব কান্নার কেন্দ্রও নই;
তবু ভবিষ্যতের কোনো অদেখা ঘরের কথা ভেবে
এভাবেই লিখে রাখি
একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক
অনুপস্থিতির বাড়ি।
—

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন