বাবার কাছে চিঠি

তসলিমা নাসরিন তসলিমা নাসরিন

বাবা তুমি কেমন আছো? এখন কি আগের মত মর্নিং ওয়াক এ যাও? ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে? ব্রহ্মপুত্রে তো জল নেই। তবে তুমি কার দিকে তাকাও? কাশফুল গাছগুলো তো আজকাল তেমন ফোটে না। তবে কি মানুষ দেখ? মানুষের ঢল নামে যে সার্কিট হাউসের মাঠে, সে মানুষ? মানুষেরা কি এখন তোমার দিকে এগিয়ে আসে আগের মতো? চেনা মানুষ বন্ধুরা, অথবা দু-চারজন পড়শি। নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেবার অপরাধে তোমাকে হাঁটতে হয় মাথা নিচু করে! গাছগাছালির আড়ালে। মানুষের শেন দৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে।
হয়ত আজকাল মর্নিং ওয়াকও ছাড়তে হয়েছে ভোরের হাওয়া খেতে আসা মানুষগুলো তোমাকে আঙ্গুল তুলে শ্বাষায় বলে। তোমার জন্য আমার বড় মায়া হয়, বড় মায়া হয় আমার।
সেই ছোটবেলায়, জুতোর মচমচ শব্দ তুলে ঢুকতে যখন বাড়িতে, এক্কা দোক্কার দাগ মুছে দৌড়ে যেতাম পড়ার টেবিলে ।
এখনো মনে আছে একদিন চুলার পাশে বসে কি একটা রান্না শিখছিলাম বলে, উঠোনে সজনে ডাঁটা ছিল তাই নিয়ে তাড়া করেছিলে যেন ঘরে যাই পড়তে বসি যেন মানুষ হই, পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে দিনে ৭০ বার তোমার 'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ' মন্ত্র শুনতে শুনতে।
মানুষ কতটুকু হয়েছি জানি না, তবে এইটুকু জানি দূর্যোগ এলে মিথ্যের খোপের মধ্যে যখন তাবৎ লোকেরা লুকোয় তখন মেরুদন্ড শক্ত করে বেশ দাঁড়াতে পারি একা। সত্যগুলো জিভের আগুনে খইয়ের মতো ফোটে আর এ কারণে আজ আমাকে লক্ষ্য মিথ্যুকেরা খুঁজছে ফাঁসি দেবে বলে, আমি হুলিয়া মাথায় নিয়ে ছুটছি ঘোর অন্ধকারে আলো নেই বুঝলে বাবা এতটুকু আলো নেই কোথাও। দেশ কি এভাবেই এরকম ভুতুড়ে অন্ধকারে ডুবে থাকবে? মানুষগুলো খোপের ভেতরে বোবা কালা অন্ধ স্বপ্নহীন বেঁচে থাকবে। দীর্ঘ আয়ু আর খাদ্য আর তসবির কৌটা আর লোভ আর মোহবাৎসর্গ নিয়ে!
তুমিও কি চোখের সামনে বোঝো যে আলো নেই!
তুমিও কি পায়ের তলায় বোঝো যে মাটি সরছে,
তুমিও কি হাতের কাছে বোঝো যে কোন বন্ধুর কাঁধ নেই, তুমিও কি মাথার উপর বোঝো যে মেঘ জমছে!
এখনো কি নতুন বাজারের আরোগ্য বিতানে বসো? রোগী দেখ? গরিব রোগীরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেয়! এইযে তোমার উদার দরজা মানুষের সেবার জন্য খোলা তুমি কি জীবনের শেষ বয়সে এসে পারো? রোগীর নাড়ি দেখতে ঠিক ঠিক! নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেওয়ার অপরাধে যারা তোমার মাথায় পাথর ছুঁড়ে মারে তারা তোমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় রোগীর কব্জি কেড়ে নেয় তোমার স্টেথেস্কোপ, এক্সরে মেশিন, মাইক্রোস্কোপ, স্কাল্পেল, ফরসেফ ?
তুমি একা পড়ে থাকো। বড় একা। কপালের দুপাশে দপদপ শিরা দুটো দুহাতে চেপে তোমার জন্য বড় মায়া হয় আমার, বড় মায়া।
একটু একটু করে যখন মানুষ হয়ে উঠছি রক্তে টগবগ করে ফুটছে যেন মানুষ হই তোমার সেই মন্ত্র। কোথায় তুমি সকালে ঘুম ভেঙে দেখবে গোলাপ যেমন পল্লবিত হয় তেমন অন্ধকার কেটে কেটে ফুটছি, আমি দু'হাত ভরে আলো আনছি থোকা থোকা । তোমার জন্যে, আর ১২ কোটি মানুষের জন্যে। তোমার তো ব্লাড প্রেসার বেশি, নিজের চিকিৎসায় তোমার কখনো মন নেই, জ্বরে গা পুড়ে গেলেও টলতে-টলতে তুমি চলে যাও রোগী দেখতে। বিনে পয়সার রোগী, নিজের রক্ত বমি রেখে অন্যের অম্বল সারাও। এই তোমাকে আজ মাথা নত করে হাঁটতে হয় রাস্তায়, দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ধর্মদ্রোহী কন্যার ফাঁসির দাবিতে। আমাদের বাড়ির দেয়ালেও নাকি বাবা? সেদিন ওরা তিন দফা ভাঙচুর করলো আমাদের বাড়িতে, তোমার চেম্বারে। ঐ ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে তোমার কি মনে হয়নি ধর্ম বেচে খায় এরা ধর্মই এদের মসনদে উঠার মসৃন সিঁড়ি? ধর্মকে তখন মনে হয়নি তোমার যে এটি আসলে বেচে খাওয়ার, এটি কেবল বোকা বানাবার অন্ধ বানাবার বধির বানাবার তেতো মিষ্ট ফল,আফিম?
তোমার জন্য মায়া হয় আমার, বড় মায়া। কতদিন দেখা হয়না তোমার সাথে। কত দীর্ঘদিন, শেষ যখন দেখি, দেখে তোমাকে মনে হয়নি তুমি সেই আগের তুমি, আগের সেই ঋজু শরীর আর নেই, আগের সেই গমগমে কন্ঠস্বর, আগের সেই জুতোর মচমচ শব্দ, আগের সেই ‌...
তুমিতো হেরেছ জীবনে অনেক, আমিও। তুমি তোমার গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলে, চেয়েছিলে ধানে, পাটে, শাকে, সবজিতে, বৃক্ষের, ফলে ছেয়ে যাক তোমার শখের গ্রাম। এত সবুজের স্বপ্ন তুমি কি করে লালন করতে? তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে যতই উপরে উঠি, যতই উঠি কোন শীর্ষের নাগাল পাইনা।এই কৌতূহলী আমিও। বিনিময়ে ঐ গ্রামের লোকেরাই তোমার মাথায় কুড়োলের কোপ বসালো। আর আমার স্বপ্নের ওপর দেশসুদ্ধ মানুষ ফেলে দিচ্ছে মন মন পাথর, গজারি কাঠ, হাতবোমা, আগুন, বিষাক্ত সাপ, ফাঁসির দড়ি, কি ভীষণ তাণ্ডব চারিদিকে তাইনা বাবা? একটি মানুষকে হত্যা করবে বলে লক্ষ্য লক্ষ্য লোক তাড়া করছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে। তুমি কি ভয় পাচ্ছ? ব্লাড প্রেসার বাড়ছে? না বাবা ভয় পেয়ো না, আমি ঠিকই দাঁড়াব। ওদের পাথর, বোমা, তলোয়ার, পিস্তলের সামনে আমি অনড় দাঁড়াব। এত অনড় দাঁড়াবো যে- ওরা হয়তো ওদের অস্ত্র নিক্ষেপ করে আমার দেহকে নির্মূল করবে। কিন্তু বিশ্বাস, বিশ্বাস তো মরবে না, যা আমি ছড়িয়ে দিয়ে গেছি হাজার মানুষের মধ‍্যে।
তা মানুষ গোপনে হলেও রোপণ করবে, ওতে জল দেবে আর চারা যদি বড় হতে হতে বৃক্ষ হয় মহীরুহ হয়, তবে জগতে কত কুড়ুল আছে যে কোপ বসাবে ওদের গায়ে? না হয় বসাক, মরা বৃক্ষের আনাচ-কানাচ থেকে আবার বুঝি অঙ্কুরোদগম হয় না! হয়। বাবা, তুমি ভেঙ্গোনা, যেমন মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলে আমাকে, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকো।
আমরা হেরে গেছি বটে আজ, আজ মানুষ চাবুক মারছে আমাদের পিঠে। একদিন দেখো তোমার গ্রামও ধানে, পাটে, শাকে, সবজিতে, বৃক্ষের, ফলে সমৃদ্ধ হবে। একদিন দেখো আমার স্বপ্নগুলো ডালপালা মেলে বিকশিত হবে। বিত্ত নেই, মান নেই আমাদের বুকের ভেতর নিষ্কলুষ স্বপ্ন ছাড়া আর কি আছে বলো বাবা, আর কি আছে?
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৩১০ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন