আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
ক্ষুদ্রলেখক মোঃ রাকিবুল হাসান

গল্প - আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।

লেখক: ক্ষুদ্রলেখক মোঃ রাকিবুল হাসান
প্রকাশ - শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ ধরণ: জীবনবাদী, বিরহ

১ আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
পড়ালেখা যে প্রচলিত মহামূল্যবান সম্পদ। এবং এটি অর্জন করার মধ্যেই সফলতা। আর সফলতা অর্জন করতে করতে হলে অজস্র কষ্ট সাধন করতে হয়। এটা হয়তো আব্বা মাষ্টার না হলে বুঝতেই পারতাম না। সুশিক্ষার মৌলিক ধারণা টা আব্বা তিল তিল করে মাত্রা ছাড়া অতি-অঙ্কনের সাথে রপ্ত করিয়েছেন। যদিও সেকালে পড়ালেখা বা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খুব কম মানুষই পড়ালেখা করতো। যারা পড়তো তারা অধিকাংশই ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। আব্বা মাষ্টার হওয়ার সুবাদে এই মহামূল্যবান রত্ন রপ্ত করা সুযোগ হয়েছিল বটে, কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার বেশি স্থায়ী হয়নি।

পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত আজকের রজনী। মনে হচ্ছে উপর থেকে আল্লাহ যেন তার ক্ষুদ্র বান্দাকে সু-শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করতে আলোর মশাল নিক্ষেপ করেছেন। আমাদের বাড়ির দরজায় একটা মেহমান খানা আছে। আগন্তুক মেহমান মুসাফির হিসেবে এখানে অবস্থান করেন। আমরা তাকে কাছারি ঘর বলি। প্রায় চারদিনের মত হবে কেরোসিন নেই, হেরিকেন জ্বলছে না। ঘর অন্ধকার। এজন্য সবাই সন্ধ্যার পর কাছারি ঘরের পাশে মাদুর বিছিয়ে গল্প করছেন। কোথাও যেন ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের সুবাসে বাতাস আশ্চর্য রকম ভারি প্রশান্তিময়। প্রচন্ড জোরে দখিনা হাওয়া বইছে, দরজার পুকুরের পানি বাতাসে ভেসে থৈ থৈ কল কলল আওয়াজ করছে। চাঁদের আলোতে পুকুর পাড়ের বালুগুলো রুপো চূর্ণের মতো ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি করছে। পশ্চিমদারের কাজি বাগানের দিক থেকে শোনা যাচ্ছে পাতি শেয়ালের ডাক। রাস্তার মাথায় বরই গাছের শাখায় শাখায় জোনাকির রঙে ঝিলমিল। এসবের বাইরে পুরো দুনিয়াজুড়ে যেন গা ছমছমে নিরাবতা। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই।

এর মধ্যে আমি পড়তেছি, বাংলা আর ভূগোল। হঠাৎ প্রচন্ড ঘুম আমাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। আমি কাছারি ঘরের পাশেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আম্মা রাতের ভাত খেতে ডাকছেন। ডেকেই যাচ্ছেন। হঠাৎ আব্বা বাড়িতে আসা মাত্রই দেখলেন আমি পথের ধারে মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছি।
আব্বা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আব্বু! এখানে মশা। রাকিব ওঠ্ ওঠটটটটট। ঘরের বিছানায় ঘুমাইতে যা। আব্বা আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন তার কোলে করে। আম্মা পান্তা ভাত নিয়ে আসলেন বিছানায়। কিন্তু আমি একেবারে ক্লান্ত থাকায় প্রচন্ড ঘুমে আচ্ছন্ন।
আমি আম্মাকে বললাম: আমি রাতে ভাত খাবো না।
আব্বা বললেন: অল্প দুগ্গা খাঁ!
আম্মা বললেন: রাত্তির অনেক বড়ো, এতো বড় রাত না খেয়ে থাকতে পারবি না।
এই বলে আমাকে দুমুঠো ভাত মুখে ভরে দিলেন। এরপর পানি পান করিয়ে, মশারী টাঙিয়ে দিলেন।

হয়তো আব্বা আম্মা রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছেন। কারণ যদি আমরা চার ভাই বোনে আহার করি তাহলে তাদের জন্য ভাতের সংকট দেখা দেয়। এযেন ভাতের হাহাকার।‌ ভাত! নাহ্ এটাকে ভাত বলে না। আমরা যেটা খাই ওটা ভাত ধোঁয়া পানি। অথবা পাশের বাড়ি থেকে আনা ভাতের মার। আম্মার বন্টন ছিল আমাদের ক্ষেত্রে খলিফা ওমরের ইনসাফের মানদণ্ডের নমুনা। সবাই কে সমান দিতেন, আমাদের দিয়েই শেষ করে ফেলতেন। পাতিল কাচানো শব্দের অর্থ আর নিবি কেউ? রাকিব আর দুগ্গা ভাত নে! অথচ পাতিলে কোন ভাত নেই। আমরা সবাই যখন জিজ্ঞেস করতাম আম্মা আপনি খাবেন না। তখন বলতেন: আমি খেয়ে আসছি, আবার বলতেন পাতিলে আমার ভাত অবশিষ্ট আছে। তোরা খা, আমি পরে খাবো। এই বলে পাতিল টা লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু আমরা তো সবাই জানি আম্মা রাতেও রোজা রাখেন। সে প্রভু ভক্ত।

আব্বার সাথে তেমন দেখাই মেলেনা, শুক্রবার ছাড়া। কারণ সে খুব সকালে পড়াতে বের হন। এরপর স্কুলে মাষ্টারি। স্কুল ছুটির পর থেকে আবার রাত নয়টা পর্যন্ত এভাবেই চলছে আব্বার কর্মজীবন। আর আমি রাত নয়টার আগেই ঘুমিয়ে যাই, আর যতো ভোরেই উঠি না কেন বাবাকে দেখতে পাই না। রিজিকের তাগিদে আরামে ঘুমের নেশা আজ পেশায় পরিনত হয়েছে। আব্বার একার রোজগারের অর্থেই চলছে ৭ সদস্যের পরিবার। এযেন হজ্জ করিতে আসিয়া কাবা ঘর না দেখে বাড়ি ফিরে যাওয়া। অর্থাৎ ঘরে থেকেও আব্বার দেখা না পাওয়া।

ইসলামের মৌলিক ধারণাটা আম্মা খুব শক্ত করে রপ্ত করিয়েছেন তার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়। বিকেলে বাজার করতে গেলে আসরের নামাজ পরতাম কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য এলাকায় চাচা দাদাদের আমার পেছনে লেলিয়ে রাখতেন। গোয়েন্দা প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী আম্মা যখন জানতেন, আজকে বাজারে নামাজ ফাঁকি দিয়েছি। তখন যেকোন মূল্যে সেই নামাজ আদায়ে বাধ্য করতেন। খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম, এই পরিবারে থাকতে হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেই থাকতে হবে। সেই বুঝের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে আমার শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনের ভিত্তি। আমি কৃতজ্ঞ আমার মমতাময়ী আম্মার কাছে। তা না হলে হয়তো যৌবনের জোয়ারে ভাসমান টগবগে শৈশব আর কৈশোর নিক্ষিপ্ত হতো অশ্লীলতা অতল গহ্বরে।

এজন্য আব্বা আম্মা\\\’র কাছে আমার আসমান সমান ঋণ। এই ঋণ শোধ করার সামান্য পরিমাণ দুঃসাহসও আমার নেই।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১৩০ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন