শংকর ব্রহ্ম

আলোচনা - ফেসবুক জীও যুগ যুগ

শংকর ব্রহ্ম
মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪

ফেসবুক জীও যুগ যুগ
শংকর ব্রহ্ম

(প্রথম পর্ব)

এই সামাজিক মাধ্যমটির সুযোগ খুব বেশী দিন হয়নি (মাত্র কুড়ি বছর আগে) মানুষের সামনে এসেছে। ইদানিং এর জনপ্রিয়তা দ্রুত হারে বেড়েই চলেছে।
ইয়েনানের ভাষণে মাও সেতুং একবার
শিল্প- সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, বলেছিলেন, ” শত পুষ্প বিকশিত হোক (Let the hundred flowers blossom).
তাঁর সে স্বপ্ন পুরণ করলেন ২০০৩ সালের জুলাই মাসে মার্ক জুকার বার্গ ‘ফেসবুক’ নামক মাধ্যমটিকে উদ্ভাবনের মাধ্যমে। সত্যিই শতপুষ্প বিকশিত হওয়ার উন্মুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হল।
গৃহেবন্দী থেকেও সহজে সারা পৃথিবীর সঙ্গে মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়ে উঠল মানুষের পক্ষে।
অনেক মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার সহজ সরল এক মাধ্যম খুঁজে পেল ফেসবুক গ্রুপে। ফলে লেখক কবির সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকল দ্রুতহারে।
আর তার ফলে এখানে মুড়ি ও মুড়কির দড় এক হয়ে দাঁড়াল। লেখার সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকল, লেখার মান তেমন (অনুশীলনের অভাবে) পড়তে থাকল দ্রুত। অনেক গ্রুপে সাহিত্য চর্চা শুরু হল। গ্রুপের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেল, লেখকের সংখ্যা বাড়ল, কিন্তু কমে এল লেখার মান, কমে এল যথার্থ পাঠকের সংখ্যাটাও।
বর্তমানে যে’কোন গ্রুপ খুললে দেখা যায়, এক একটা গ্রুপে যত লেখক লেখে, সেইসব লেখা তত পাঠক পড়ে না। এমন কি গ্রুপের কবি-লেখকরাও অন্যদের লেখা পড়েন না। লাইক কমেন্ট করেন না। এটা একটা ভীষণ নঞর্থক দিক।
তবে কেউ কেউ লাইক কমেন্ট করেন। এতে তাৎক্ষণিক একটা অভিমত পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা কতখানি সঠিক সে সম্পর্কে শেষপর্যন্ত সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায় ।

দিনদিন মানুষের মধ্যে ফেসবুকের আসক্তি যেমন বাড়ছে, সেটাও দুশ্চিন্তার একটা কারণ হয়ে উঠেছে সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে আজকাল।

এতসব ভাল মন্দ বিচার করেও বলা যায় ফেসবুক সাহিত্য যুগ যুগ জীও।

তবে লেখকের স্বাধীনতা এখানে কতটা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায় শেষ পর্যন্ত। কারণ, যে কোন গ্রুপের নিয়মাবলী পড়লেই দেখা যায়, স্পষ্ট করে সেখানে লেখা থাকে, তিনটি বিষয়ে লেখা পোষ্ট করা যাবে না।
১).যৌনতা বিষয়ক
২).ধর্ম বিষয়ক
৩). রাজনীতি বিষয়ক

কিন্তু, কেন রে বাবা, এই তিনটি জিনিষ কি আমাদের জীবন খেকে বাদ হয়ে গেছে?
নাকি আমাদের জীবনে এসবগুলির কোন প্রভাব বা মূল্য নেই অথবা নিষিদ্ধ?

আমরা কি জীবনে যৌনতা করি না?
আমরা কি জীবনে ধর্মচর্চা করি না?
আমরা কি জীবনে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করি না?
তাহলে এগুলো প্রকাশে এত বাধা থাকবে কেন?
অথচ এই তিনটি জিনিষকে – জীবনের চালিকা শক্তি ও নিয়ন্ত্রক বলা চলে।
সাহিত্য যদি সত্যিই জীবনের প্রতিফলন হয়, তাহলে এ’গুলো প্রকাশে বাধা থাকলে, জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ কি করে সম্ভব হবে?
১.যৌনতা – প্রকাশে দ্বিধা ( লজ্জা)?
২.ধর্ম – প্রকাশে সংকোচ(কে কি ভাববে)?
৩.রাজনীতি – প্রকাশে ভয় (আক্রমণের)?
কথায় বলে,
দ্বিধা সংকোচ ভয়, তিন থাকতে নয়।
তাই আমাদের ফেসবুক সাহিত্যে আজও সাবালকত্ব প্রাপ্ত হল না ঠিক এই একটা কারণেই। লেখায় যত বিধি নিষেধ আরোপ করে লেখাকে বন্ধ্যা করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা য়ায়।
তাই একই গড্ডলিকা স্রোতে ভেসে চলেছে ফেসবুক সাহিত্য, আলোড়িত হবার মতো সে রকম হৃদয় কাঁপানো লেখা কই?
যেখানে লেখকের খুশি মতো লেখার কোন স্বাধীনতা নেই, সেখানে ভাল লেখার আশা করা যায় না?
অবশ্য স্বাধীনতার সাথে সেচ্ছাচারিতাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
তাই আমাদের আমাদের ফেসবুক সাহিত্য সাবালকত্ব প্রাপ্ত হবার আগেই নাবালকত্ব থেকে (যৌবনের উদ্দাম মাদকতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে) , অকালে বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে।
এ’ব্যাপারে লেখক ও পাঠকদের মতামত প্রত্যাশা করি।

(দ্বিতীয় পর্ব)

সম্প্রতি আমি লেখক ও পাঠকদের কাছে
একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম,ফেসবুক সাহিত্যে কি –
১). ধর্ম
২). রাজনীতি
৩).যৌনতা
ব্রাত্য হয়ে থাকবে?
১৮৩ জন বলেছেন, না তা থাকা উচিৎ নয়।
১২ জন বলেছেন, তাদের মনেও এই একই প্রশ্ন জেগেছে, কিন্তু তারা সে প্রশ্ন তুলতে সাহস পাননি।
৬ জন আপত্তি করেছেন, আমি কেন এ’ধরণের প্রশ্ন তুলে গ্রুপের পরিবেশ নষ্ট করছি? এই প্রশ্ন তোলার তুলে কিছু বন্ধু শত্রু আমাকে শত্রু ভেবেছেন, কিছু বন্ধু আমার রুচি বিকার ঘটেছে ভেবে আমায় ত্যাগ করেছেন। গ্রুপ থেকে লীভ নিতে বাধ্য করছে কেউ কেউ। তা’ছাড়া আপত্তি তুলেছে দুটি গ্রুপের পরিচালক মন্ডলীর কেউ কেউ।
তারা অবশ্য আমায় গ্রুপ ছাড়তে বাধ্য করেনি, এ’টুকু সৌজন্যবোধ ও সহনশীলতা তাদের আছে দেখে আমার ভাল লেগেছে।
এ’সব অবশ্য চিন্তার কোন বিষয় নয় আমার কাছে। যারা আপত্তি তুলেছেন, তারা বেশির ভাগই সেই সব গ্রুপের কর্নধার বা অ্যাডমিন। গ্রুপে বিতর্ক থাকা স্বাস্থ্যকর বলে আমার মনে হয়েছে। না হলে গ্রুপ বদ্ধ জলাশয় হয়ে পড়ে। স্থির জলে একটু আলোড়ণ উঠলে ক্ষতি কি?
তবে একটা বিষয় তার মধ্যে লক্ষ্যণীয়,
তারা রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে যতটা না সোচ্চার হয়েছেন,তার চেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছেন যৌনতা নিয়ে। তাহলে কি, যৌনতার এত রক্ষণশীলতাই সমাজে দিন দিন ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার নিগূঢ় কারণ বলে মনে হয় না ?
আমাদের পরিবারের কেউ রাজনীতি করলে আমরা তেমন আপত্তি তুলি না। ধর্ম নিয়ে মেতে থাকলেও আপত্তির কারণ ঘটে না। কিন্তু পরিবারের কেউ যদি যৌনাচারে লিপ্ত হয়, বা রক্ষিতা রাখে আমরা রে রে করে উঠি। এর কারণ কি, আমাদের মনের অবদমিত যৌনাচার নয়? আর এই অবদমিত যৌনাচারই সমাজে দিনের পর দিন ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করেন, সমাজতত্ববিদরা , ফ্রয়েড, ইয়ুং থেকে আধুনিক মনস্তত্ববিদরা অনেকেই।
যে সব সমাজে যৌনতা নিয়ে এত রাখঢাক নেই, সেখানে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। নিষিদ্ধ জিনিষের উপর স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের কৌতূহল ও আকর্ষণ বেশি থাকে।
এ থেকে মুক্তি পেতে গেলে রক্ষণশীলতার বেড়া একটু আলগা না করলে, হুড়মুড় করে স্বাভাবিক নিয়মেই সে বেড়া একদিন ভেঙে পড়বে। ‘বাঁধন যত শক্ত হবে,সে বাঁধন তত টুটবে।’

১১৭
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন