অৰ্জ্জুন
কোনাে গৃহ নাই তব প্রিয়ে, যে ভবনে
কাঁদিছে বিরহে তব প্রিয় পরিজন?
নিত্য স্নেহ-সেবা দিয়ে যে আনন্দপুরী
রেখেছিলে সুধাময় করে’, যেথাকার
প্রদীপ নিয়ে দিয়ে এসেছ চলিয়া
অরণ্যের মাঝে? আপন শৈশবস্মৃতি
যেথায় কাঁদিতে যায় হেন স্থান নাই?
চিত্রাঙ্গদা
প্রশ্ন কেন? তবে কি আনন্দ মিটে গেছে?
যা’ দেখিছ তাই আমি, আর কিছু নাই
পরিচয়। প্রভাতে এই যে দুলিতেছে
কিংশুকের একটি পল্লব প্রান্তভাগে
একটি শিশির, এর কোনাে নাম ধাম
আছে? এর কি শুধায় কেহ পরিচয়?
তুমি যারে ভালবাসিয়াছ, সে এমনি
শিশিরের কণা, নামধামহীন।
অর্জ্জুন
কিছু
তা’র নাই কি বন্ধন পৃথিবীতে? এক
বিন্দু স্বর্গ শুধু ভূমিতলে ভুলে’ পড়ে’
গেছে?
চিত্রাঙ্গদা
তাই বটে। শুধু নিমেষের তরে
দিয়েছে আপন উজ্জ্বলতা অরণ্যের
কুসুমেরে।
অর্জ্জুন
তাই সদা হারাই হারাই
করে প্রাণ, তৃপ্তি নাহি পাই, শান্তি নাহি
মানি। সুদুর্লভ, আরো কাছাকাছি এস।
মানুষের মত, নামধামগােত্রগৃহ-
দেহমনবাক্যে, সহস্র বন্ধনে দাও
ধরা। চারিপার্শ্ব হ’তে পরশি তােমারে,
নির্ভয়নির্ভরে করি বাস! নাম নাই?
তবে কোন্ প্রেমমন্ত্রে জপিব তােমারে
হৃদয়মন্দিরমাঝে? গােত্র নাই? তবে
কি মৃণালে এ কমল ধরিয়া রাখিব?
চিত্রাঙ্গদা
নাই, নাই, নাই।—যারে বাঁধিবারে চাও
কখনাে সে বন্ধন জানেনি। সে কেবল
মেঘের সুবর্ণছটা, গন্ধ কুসুমের,
তরঙ্গের গতি।
অর্জ্জুন
তাহারে যে ভালবাসে
অভাগা সে। প্রিয়ে, দিয়াে না প্রেমের হাতে
আকাশকুসুম। বুকে রাখিবার ধন
দাও তা’রে সুখে দুঃখে সুদিনে দুর্দ্দিনে।
চিত্রাঙ্গদা
এখনাে যে বর্ষ যায় নাই, শ্রান্তি এরি
মাঝে? হায় হায় এখন বুঝিনু, পুষ্প
স্বল্প-পরমায়ু দেবতার আশীর্ব্বাদে।
গতবসন্তের যত মৃতপুষ্পসাথে
ঝরিয়া পড়িত যদি এ মােহন তনু
আদরে মরিত হবে। বেশি দিন নহে
পার্থ! যে ক’দিন আছে, আশা মিটাইয়া
কুতুহলে, আনন্দের মধুটুকু তা’র
নিঃশেষ করিয়া কর পান। এর পরে
বারবার আসিয়াে না স্মৃতির কুহকে
ফিরে’ ফিরে’, গত সায়াহ্নের চ্যুতবৃন্ত
মাধবীর আশে, তৃষিত ভূঙ্গের মত।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন