রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - প্রতীক্ষা

লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওরে মৃত্যু , জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে
বেঁধেছিস বাসা ।
যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
স্নেহ-ভালোবাসা ,
গোপন মনের আশা , জীবনের দুঃখ সুখ ,
মর্মের বেদনা ,
চিরদিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা
বাসনা-সাধনা ;
যেখানে নন্দন-ছায়ে নিঃশঙ্কে করিছে খেলা
অন্তরের ধন ,
স্নেহের পুত্তলিগুলি , আজন্মের স্নেহস্মৃতি ,
আনন্দকিরণ ;
কত আলো , কত ছায়া , কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
গীতিময়ী ভাষা —
ওরে মৃত্যু , জানিয়াছি , তারি মাঝখানে এসে
বেঁধেছিস বাসা!

নিশিদিন নিরন্তর জগৎ জুড়িয়া খেলা ,
জীবন চঞ্চল ।
চেয়ে দেখি রাজপথে চলেছে অশ্রান্তগতি
যত পানথদল ;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে পাখিগুলি উড়ে যায়
প্রাণপূর্ণ বেগে ,
সমীরকম্পিত বনে নিশিশেষে নব নব
পুষ্প উঠে জেগে ;
চারি দিকে কত শত দেখাশোনা আনাগোনা
প্রভাতে সন্ধ্যায় ;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে খুলিতেছে জীবনের
নূতন অধ্যায় ;
তুমি শুধু এক প্রান্তে বসে আছ অহর্নিশি
স্তব্ধ নেত্র খুলি —
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া ,
বক্ষ উঠে দুলি ।

যে সুদূর সমুদ্রের পরপার-রাজ্য হতে
আসিয়াছ হেথা ,
এনেছ কি সেথাকার নূতন সংবাদ কিছু
গোপন বারতা ।
সেথা শব্দহীন তীরে ঊর্মিগুলি তালে তালে
মহামন্দ্রে বাজে ,
সেই ধ্বনি কী করিয়া ধ্বনিয়া তুলিছ মোর
ক্ষুদ্র বক্ষোমাঝে ।
রাত্রি দিন ধুক ধুক হৃদয়পঞ্জর-তটে
অনন্তের ঢেউ ,
অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে
শুনিছে না কেউ ।
আমার এ হৃদয়ের ছোটোখাটো গীতগুলি ,
স্নেহ-কলরব ,
তারি মাঝে কে আনিল দিশাহীন সমুদ্রের
সংগীত ভৈরব ।

তুই কি বাসিস ভালো আমার এ বক্ষোবাসী
পরান-পক্ষীরে ,
তাই এর পার্শ্বে এসে কাছে বসেছিস ঘেঁষে
অতি ধীরে ধীরে ?
দিনরাত্রি নির্নিমেষে চাহিয়া নেত্রের পানে
নীরব সাধনা ,
নিস্তব্ধ আসনে বসি একাগ্র আগ্রহভরে
রুদ্র আরাধনা ।
চপল চঞ্চল প্রিয়া ধরা নাহি দিতে চায় ,
স্থির নাহি থাকে ,
মেলি নানাবর্ণ পাখা উড়ে উড়ে চলে যায়
নব নব শাখে ;
তুই তবু একমনে মৌনব্রত একাসনে
বসি নিরলস ।
ক্রমে সে পড়িবে ধরা , গীত বন্ধ হয়ে যাবে
মানিবে সে বশ ।

তখন কোথায় তারে ভুলায়ে লইয়া যাবি —
কোন্‌ শূন্যপথে ,
অচৈতন্য প্রেয়সীরে অবহেলে লয়ে কোলে
অন্ধকার রথে!
যেথায় অনাদি রাত্রি রয়েছে চিরকুমারী —
আলোক-পরশ
একটি রোমা \’ রেখা আঁকে নি তাহার গাত্রে
অসংখ্য বরষ ;
সৃজনের পরপ্রান্তে যে অনন্ত অন্তঃপুরে
কভু দৈববশে
দূরতম জ্যোতিষ্কের ক্ষীণতম পদধ্বনি
তিল নাহি পশে ,
সেথায় বিরাট পক্ষ দিবি তুই বিস্তারিয়া
বন্ধনবিহীন ,
কাঁপিবে বক্ষের কাছে নবপরিণীতা বধূ
নূতন স্বাধীন ।

ক্রমে সে কি ভুলে যাবে ধরণীর নীড়খানি
তৃণে পত্রে গাঁথা —
এ আনন্দ-সূর্যালোক , এই স্নেহ , এই গেহ ,
এই পুষ্পপাতা ?
ক্রমে সে প্রণয়ভরে তোরেও কি করে লবে
আত্মীয় স্বজন ,
অন্ধকার বাসরেতে হবে কি দুজনে মিলি
মৌন আলাপন ।
তোর স্নিগ্ধ সুগম্ভীর অচঞ্চল প্রেমমূর্তি ,
অসীম নির্ভর ,
নির্নিমেষ নীল নেত্র , বিশ্বব্যাপ্ত জটাজূট ,
নির্বাক অধর —
তার কাছে পৃথিবীর চঞ্চল আনন্দগুলি
তুচ্ছ মনে হবে ;
সমুদ্রে মিশিলে নদী বিচিত্র তটের স্মৃতি
স্মরণে কি রবে ?

ওগো মৃত্যু , ওগো প্রিয় , তবু থাক্‌ কিছুকাল
ভুবনমাঝারে ।
এরি মাঝে বধূবেশে অনন্তবাসর-দেশে
লইয়ো না তারে ।
এখনো সকল গান করে নি সে সমাপন
সন্ধ্যায় প্রভাতে ;
নিজের বক্ষের তাপে মধুর উত্তপ্ত নীড়ে
সুপ্ত আছে রাতে ;
পানথপাখিদের সাথে এখনো যে যেতে হবে
নব নব দেশে ,
সিন্ধুতীরে , কুঞ্জবনে নব নব বসন্তের
আনন্দ-উদ্দেশে ।
ওগো মৃত্যু , কেন তুই এখনি তাহার নীড়ে
বসেছিস এসে ?
তার সব ভালোবাসা আঁধার করিতে চাস
তুই ভালোবেসে ?

এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী- \’ পরে
মুহূর্তের খেলা ,
এই সব মুখোমুখি এই সব দেখাশোনা
ক্ষণিকের মেলা ,
প্রাণপণ ভালোবাসা সেও যদি হয় শুধু
মিথ্যার বন্ধন ,
পরশে খসিয়া পড়ে , তার পরে দণ্ড-দুই
অরণ্যে ক্রন্দন —
তুমি শুধু চিরস্থায়ী , তুমি শুধু সীমাশূন্য
মহাপরিণাম ,
যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে
অনন্ত বিশ্রাম —
তবে মৃত্যু , দূরে যাও , এখনি দিয়ো না ভেঙে
এ খেলার পুরী ;
ক্ষণেক বিলম্ব করো , আমার দুদিন হতে
করিয়ো না চুরি ।

একদা নামিবে সন্ধ্যা , বাজিবে আরতিশঙ্খ
অদূর মন্দিরে ,
বিহঙ্গ নীরব হবে , উঠিবে ঝিল্লির ধ্বনি
অরণ্য-গভীরে ,
সমাপ্ত হইবে কর্ম , সংসার-সংগ্রাম-শেষে
জয়পরাজয় ,
আসিবে তন্দ্রার ঘোর পান্থের নয়ন \’ -পরে
ক্লান্ত অতিশয় ,
দিনান্তের শেষ আলো দিগন্তে মিলায়ে যাবে ,
ধরণী আঁধার —
সুদূরে জ্বলিবে শুধু অনন্তের যাত্রাপথে
প্রদীপ তারার ,
শিয়রে শয়ন-শেষে বসি যারা অনিমেষে
তাহাদের চোখে
আসিবে শ্রান্তির ভার নিদ্রাহীন যামিনীতে
স্তিমিত আলোকে —

একে একে চলে যাবে আপন আলয়ে সবে
সখাতে সখীতে ,
তৈলহীন দীপশিখা নিবিয়া আসিবে ক্রমে
অর্ধরজনীতে ,
উচ্ছ্বসিত সমীরণ আনিবে সুগন্ধ বহি
অদৃশ্য ফুলের ,
অন্ধকার পূর্ণ করি আসিবে তরঙ্গধ্বনি
অজ্ঞাত কূলের —
ওগো মৃত্যু , সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে
এসো বরবেশে ।
আমার পরান-বধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া
বহু ভালোবেসে
ধরিবে তোমার বাহু ; তখন তাহারে তুমি
মন্ত্র পড়ি নিয়ো ,
রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বন দানে
পাণ্ডু করি দিয়ো ।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৩৭৭ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন