রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - বিশ্বনৃত্য

লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
কে বাজাবে সেই বাজনা!
উঠিবে চিত্ত করিয়া নৃত্য ,
বিস্মৃত হবে আপনা ।
টুটিবে বন্ধ মহা আনন্দ ,
নব সংগীতে নূতন ছন্দ ,
হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাবে নবীন বাসনা ।

সঘন অশ্রুমগন হাস্য
জাগিবে তাহার বদনে ।
প্রভাত-অরুণকিরণরশ্মি
ফুটিবে তাহার নয়নে ।
দক্ষিণ করে ধরিয়া যন্ত্র
ঝনন রণন স্বর্ণতন্ত্র ,
কাঁপিয়া উঠিবে মোহন মন্ত্র
নির্মল নীল গগনে ।

হা হা করি সবে উচ্ছল রবে
চঞ্চল কলকলিয়া
চৌদিক হতে উন্মাদ স্রোতে
আসিবে তূর্ণ চলিয়া ।
ছুটিবে সঙ্গে মহাতরঙ্গে
ঘিরিয়া তাঁহারে হরষরঙ্গে
বিঘ্নতরণ চরণভঙ্গে
পথকন্টক দলিয়া ।

দ্যুলোক চাহিয়া সে লোকসিন্ধু
বন্ধনপাশ নাশিবে ,
অসীম পুলকে বিশ্ব-ভূলোকে
অঙ্কে তুলিয়া হাসিবে ।
ঊর্মিলীলায় সূর্যকিরণ
ঠিকরি উঠিবে হিরণবরন ,
বিঘ্ন বিপদ দুঃখ মরণ
ফেনের মতন ভাসিবে ।

ওগো কে বাজায় , বুঝি শোনা যায় ,
মহা রহস্যে রসিয়া ,
চিরকাল ধরে গম্ভীর স্বরে
অম্বর- ‘ পরে বসিয়া ।
গ্রহমণ্ডল হয়েছে পাগল ,
ফিরিছে নাচিয়া চিরচঞ্চল —
গগনে গগনে জ্যোতি-অঞ্চল
পড়িছে খসিয়া খসিয়া ।

ওগো কে বাজায় কে শুনিতে পায় ,
না জানি কী মহা রাগিণী!
দুলিয়া ফুলিয়া নাচিছে সিন্ধু
সহস্রশির নাগিনী ।
ঘন অরণ্য আনন্দে দুলে —
অনন্ত নভে শত বাহু তুলে ,
কী গাহিতে গিয়ে কথা যায় ভুলে ,
মর্মরে দিনযামিনী ।

নির্ঝর ঝরে উচ্ছ্বাসভরে
বন্ধুর শিলা-সরণে ।
ছন্দে ছন্দে সুন্দর গতি
পাষাণহৃদয়-হরণে ।
কোমল কণ্ঠে কুল্‌ কুল্‌ সুর
ফুটে অবিরল তরল মধুর ,
সদাশিঞ্জিত মানিকনূপুর
বাঁধা চঞ্চল চরণে ।

নাচে ছয় ঋতু , না মানে বিরাম ,
বাহুতে বাহুতে ধরিয়া
শ্যামল স্বর্ণ বিবিধ বর্ণ
নব নব বাস পরিয়া ।
চরণ ফেলিতে কত বনফুল
ফুটে ফুটে টুটে হইয়া আকুল ,
উঠে ধরণীর হৃদয় বিপুল
হাসি-ক্রন্দনে ভরিয়া ।

পশু-বিহঙ্গ কীটপতঙ্গ
জীবনের ধারা ছুটিছে ।
কী মহা খেলায় মরণবেলায়
তরঙ্গ তার টুটিছে ।
কোনোখানে আলো কোনোখানে ছায়া ,
জেগে জেগে ওঠে নব নব কায়া ,
চেতনাপূর্ণ অদ্ভুত মায়া
বুদ্‌বুদ সম ফুটিছে ।

ওই কে বাজায় দিবস-নিশায়
বসি অন্তর-আসনে ,
কালের যন্ত্রে বিচিত্র সুর —
কেহ শোনে কেহ না শোনে ।
অর্থ কী তার ভাবিয়া না পাই ,
কত গুণী জ্ঞানী চিন্তিছে তাই ,
মহান মানব-মানস সদাই
উঠে পড়ে তারি শাসনে ।

শুধু হেথা কেন আনন্দ নাই ,
কেন আছে সবে নীরবে ?
তারকা না দেখি পশ্চিমাকাশে ,
প্রভাত না দেখি পুরবে ।
শুধু চারি দিকে প্রাচীন পাষাণ
জগৎ-ব্যাপ্ত সমাধিসমান
গ্রাসিয়া রেখেছে অযুত পরান ,
রয়েছে অটল গরবে ।

সংসারস্রোত জাহ্নবীসম
বহু দূরে গেছে সরিয়া ।
এ শুধু ঊষর বালুকাধূসর
মরুরূপে আছে মরিয়া ।
নাহি কোনো গতি , নাহি কোনো গান ,
নাহি কোনো কাজ , নাহি কোনো প্রাণ ,
বসে আছে এক মহানির্বাণ ,
আঁধার-মুকুট পরিয়া ।

হৃদয় আমার ক্রন্দন করে
মানব-হৃদয়ে মিশিতে —
নিখিলের সাথে মহা রাজপথে
চলিতে দিবস-নিশীথে ।
আজন্মকাল পড়ে আছি মৃত
জড়তার মাঝে হয়ে পরাজিত ,
একটি বিন্দু জীবন-অমৃত
কে গো দিবে এই তৃষিতে ?

জগৎ-মাতানো সংগীততানে
কে দিবে এদের নাচায়ে!
জগতের প্রাণ করাইয়া পান
কে দিবে এদের বাঁচায়ে!
ছিঁড়িয়া ফেলিবে জাতিজালপাশ ,
মুক্ত হৃদয়ে লাগিবে বাতাস ,
ঘুচায়ে ফেলিয়া মিথ্যা তরাস
ভাঙিবে জীর্ণ খাঁচা এ ।

বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
বাজুক বিশ্ববাজনা!
উঠুক চিত্ত করিয়া নৃত্য
বিস্মৃত হয়ে আপনা ।
টুটুক বন্ধ , মহা আনন্দ ,
নব সংগীতে নূতন ছন্দ —
হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাক নবীন বাসনা ।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১৪১ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন