হেলাল হাফিজ: অনুপম বিচ্ছেদি পঙক্তির কারিগর || অন্তর চন্দ্র
হেলাল হাফিজ: অনুপম বিচ্ছেদি পঙক্তির কারিগর || অন্তর চন্দ্র
antorchandro

আলোচনা - হেলাল হাফিজ: অনুপম বিচ্ছেদি পঙক্তির কারিগর || অন্তর চন্দ্র

লেখক: antorchandro
প্রকাশ - মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ছোট ছোট ব্যথাকে শব্দগুচ্ছে বেঁধে বেঁধে যিনি কবিতা লিখতেন, কবিতার মত করে একটা বিদ্রোহ আঁকতেন, একটা প্রেমের ছবি, ‌ ব্যথিত প্রেমের ছবি, যার বুকে ছোবল দিয়ে বারবার কবিতার অমরত্বকে তুলে এনেছে তিনি হেলাল হাফিজ। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখতে গিয়ে যে লোকটি নির্জনতা খুন করেছিল, সেই মানুষটিকে বাথরুমে আছড়ে পড়ে মরতে হলো; জীবন সঙ্গী ছাড়া একা কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন, এতো কঠোর পণ নিয়ে যৌবনকে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতার খাতা ভরালেন, এখন তাঁর ‘মরণের পাখা গজিয়েছে।’ তিনি সমাধিস্থ হলেন, পাঠক হৃদয়ের অমৃতলোকে তাঁর অন্তিম ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ল; কিন্তু সময়ের অমোঘ বাণী থেকে গেল মহাকালের বুকে ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

শুধুমাত্র একটি কবিতা লিখেই যিনি পেয়েছেন তারকা খ্যাতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুল-কলেজের দেয়ালে, চায়ের আড্ডায়, হাটে-বাজারে মানুষের মুখে মুখে ৬৯ —এর গণঅভ্যুত্থানে রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র পাঠ। ১৯৮৬ প্রকাশ হলো ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তারপর চলে গেল অনেকটা বছর ব‌ই প্রকাশের খবর নেই, পরবর্তীতে ২০১২ সালে ‘কবিতা ৭১’ এবং সর্বশেষ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা (২০১৯)’ সালে প্রকাশিত হয়। এতো কম লিখে মনোসংযোগ সৃষ্টি করতে কবি হেলাল হাফিজের মতো মানুষ‌ই পারে, যিনি সৃষ্টিকে অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন, জনমানসে, বেদনার কারিগর হয়ে, সাগরকে উপেক্ষা করে ছন্দাতীত শব্দের দোলনায় তাঁর কবিতার বয়ে চলা।

তাঁর কবিতায় সংসার বিরাগীর কথা, ব্যথিত পুরুষের না পাওয়ার যাতনা, প্রেমের নামে প্রতারণা, অগ্ন্যুৎসব, মিছিল, যুদ্ধ, মুক্তিকামী মানুষের নামে একটি পতাকার স্বপ্ন; এইসব দিনরাত্রির মিছিলে কবি একাকী নির্জনে শব্দগুচ্ছ সাজাচ্ছেন। প্রেমিকা হেলেন অন্যকারো, নিজে সংসার বিরাগী পৃথক পাহাড় নিয়ে মেতে থাকেন জীবনের অস্থিতে অস্থিতে; নাকি অন্য ভুবনের আমোদ ফুর্তি করে বোহিমিয়ান জীবন কাটান।

কষ্টের ফেরিওয়ালা, কষ্টের বেচাকেনা করে যার সংসার চলে, তাঁর কষ্টেরা কেমন আছে কোনদিন জানতে চেয়েছি কি? চাইনি তো! তাই দিনের পর রাত আসে, সন্ধ্যা হয়, ভোর আসে কবি তাকিয়ে থাকেন সময়ের সুর তুলে— তিনি হেসে ইদানিং জীবন যাপনের খবর দেন।

‘আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন।
প্রিয় দেশবাসী;
আপনারা কেমন আছেন?’ (ইদানিং জীবন যাপন)

‘হে কবি
দেখো চারিদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই।’ (যুগল জীবনী)

‘এতদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।’ (দুঃখের আরেক নাম)

এতসব পঙক্তির ভিড়ে একজন কবির নিবিড় আলাপ; প্রজাপতির মসৃণ পাখার মত একেকটি পঙক্তির বিন্যাস, আমাকে মুগ্ধ করে, বিরহী প্রেমিক করে তোলে— কবি এখানে শুধু দুঃখেরই প্রকাশ করেছেন, তার দুঃখকে ছাই চাপা দিতে চাননি বরং সারাটা জীবন দুঃখগুলোকে পুষে পুষে একটা দুঃখময় সংসার গড়ে তুলেছেন, সেখানে একাকী কোন প্রেমিকা তাকে খুঁজে ছিল কিনা সে খবর পাওয়া যায় না।

হেলাল হাফিজের কবিতায় বেশিরভাগ তার বেদনাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; প্রত্যেকটি কবিতার ভিতরে তার যাপনের অনুপম সৃষ্টি, তিনি অনুপম বিচ্ছেদি পঙক্তির কারিগর। তার জীবনকালে তিনি বেশিরভাগ আত্মহত্যা কিংবা মৃত্যু নিয়ে পড়তে ভালোবাসতেন, সেই ভালোবাসার গঠনগুলোও মৃত্যু কিংবা বেদনাকে কেন্দ্র করে উঠে আসত কবিতার ভাষায়। আর এতটা ধৈর্য নিয়ে কোন একজন কবি কবিতা লিখেছেন বলে আমার মনে হয় না কারণ একটি মাত্র বই প্রকাশ হওয়ার পর ২৬ বছর অপেক্ষার অবসানে দ্বিতীয় বইয়ের প্রকাশ এবং ৫ বছর অপেক্ষার পর সর্বশেষ ব‌‌ইয়ের প্রকাশ সত্যিই আশ্চর্যকর! সারাজীবনে মাত্র তিনটি কবিতার ব‌ই লিখেছেন;— এরকমটা তখনই হয় যখন একজন জাত শিল্পী তার সৃষ্টিকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন এবং জনমানসে সৃষ্টিশীলতার আয়ু দান করেন।

কিংবদন্তিতুল্য হেলাল হাফিজ আমার চোখে একটা আগুনের ফুলকি যেটা শুধুমাত্র জ্বলতে থাকে, তুষের মতো, আগ্নেয়গিরির মতো, যার কষ্টকে ভগ্নাংশ দ্বারা ভাগ করা যায় না, অণু কিংবা পরমাণু নয়— এটা একটা শক্তি যার নাম কবিত্ব; যেটা ধারণের জন্য একমাত্র যাপন কবিতা।

‘আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে
মানুষের কাছে এওতো আমার এক ধরনের ঋণ।’ ( অচল প্রেমের পদ্য ০৯)

‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছ !’ (অচল প্রেমের পদ্য ১৩)

‘একদিন সব কিছু ছিলো তোর ডাক নামে,
পোড়ামুখী তবু তোর ভরলো না মন—
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।’ (সম্প্রদান )

‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর’ ( হৃদয়ের ঋণ )

‘প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।’ ( ফেরিওয়ালা)

কবিতার উৎকর্ষ এবং বৈচিত্রতা হেলাল হাফিজের কবিতায় মুখ্য বিষয়। কবি তাঁর সমগ্র জীবনকে কলমের খোঁচায় খোঁচায় তুলে এনেছেন, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি দীর্ঘ সময়কে তিনি কাছে থেকে উপলব্ধি করেছেন, নিজের বেদনার কালযাপনকে তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন কিন্তু ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র পর অর্থাৎ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশের পরই কবি যেন নির্জন সাধনে কিংবা একেবারেই না ছোঁয়ার বাইরে চলে যান। যাকে নিয়ে এতো হৈচৈ সেই কিনা দুঃখকে পুঁজি করে নিজেকে কবিতার চাদরে ঢেকে রাখতে পছন্দ করেন। আসলে, হেলাল হাফিজ ছিলেন অর্ন্তলোকের মানুষ; নির্জন সাধনে ব্যস্ত একটি ধ্রুবতারা, যিনি এখন শায়িত নক্ষত্রলোকে।

_____________________________
অন্তর চন্দ্র (কবি ও গদ্যকার )
চিলমারী, কুড়িগ্রাম।
sreeantorchandrob@gmail.com
০১৭৪৮৮৯৪০৩৭

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১২০ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন