খদ্যোত

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

খদ্যোত যে কেন আমাদিগের উপহাসের স্থল, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। বোধ হয়, চন্দ্র সূর্য্যাদি বৃহৎ আলোকাধার সংসারে আছে বলিয়াই জোনাকির এত অপমান। যেখানেই অল্পগুণবিশিষ্ট ব্যক্তিকে উপহাস করিতে হইবে, সেইখানেই বক্তা বা লেখক জোনাকির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আমি দেখিতে পাই যে, জোনাকির অল্প হউক, অধিক হউক, কিছু আলো আছে-কই, আমাদের ত কিছুই নাই। এই অন্ধকারে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার পথ আলো করিলাম? কে আমাকে দেখিয়া, অন্ধকারে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার পথ আলো করিলাম? কে আমাকে দেখিয়া, অন্ধকারে, দুস্তরে, প্রান্তরে, দুর্দ্দিনে, বিপদে, বিপাকে বলিয়াছে, এস ভাই, চল চল, ঐ দেখ আলো জ্বলিতেছে, চল, ঐ আলো দেখিয়া পথ চল? অন্ধকার! এ পৃথিবী ভাই বড় অন্ধকার! পথ চলিতে পারি না। যখন চন্দ্র সূর্য্য থাকে, তখন পথ চলি-নহিলে পারি না। তারাগণ আকাশে উঠিয়া, কিছু আলো করে বটে, কিন্তু দুর্দ্দিনে ত তাহাদের দেখিতে পাই না। চন্দ্রসূর্য্যও সুদিনে-দুর্দ্দিনে, দুঃসময়ে, যখন মেঘের ঘটা, বিদ্যুতের ছটা, একে রাত্রি, তাহাতে ঘোর বর্ষা, তখন কেহ না। মনুষ্যনির্ম্মিত যন্ত্রের ন্যায় তাহারাও বলে- “Hora non numero nisi serenas!” কেবল তুমি খদ্যোৎ,-ক্ষুদ্র, হীনভাস, ঘৃণিত, সহজে হন্য, সর্ব্বদা, হত-তুমিই সেই অন্ধকার দুর্দ্দিনে বর্ষাবৃষ্টিতে দেখা দাও। তুমিই অন্ধকারে আলো। আমি তোমাকে ভাল বাসি।

আমি তোমায় ভাল বাসি, কেন না, তোমার অল্প, অতি অল্প আলো আছে-আমিও মনে জানি, আমারও অল্প, অতি অল্প আলো আছে-তুমিও অন্ধকারে, আমিও ভাই, ঘোর অন্ধকারে। অন্ধকারে সুখ নাই কি? তুমিও অনেক অন্ধকারে বেড়াইয়াছ-তুমি বল দেখি? যখন নিশীথমেঘে জগৎ আচ্ছন্ন, বর্ষা হইতেছে ছাড়িতেছে, ছাড়িতেছে হইতেছে ; চন্দ্র নাই, তারা নাই, আকাশের নীলিমা নাই, পৃথিবীর দীপ নাই-প্রস্ফুটিত কুসুমের শোভা পর্য্যন্ত নাই-কেবল অন্ধকার, অন্ধকার! কেবল অন্ধকার আছে-আর তুমি আছ-তখন, বল দেখি, অন্ধকারে কি সুখ নাই? সেই তপ্ত রৌদ্রপ্রদীপ্ত কর্কশ স্পর্শপীড়িত, কঠোর শব্দে শব্দায়মান অসহ্য সংসারের পরিবর্ত্তে সংসার আর তুমি! জগতে অন্ধকার ; আর মুদিত কামিনীকুসুম জলনিষেকতরুণায়িত বৃক্ষের পাতায় পাতায় তুমি! বল দেখি ভাই, সুখ আছে কি না?

আমি ত বলি আছে। নহিলে কি সাহসে, তুমি ঐ বন্যান্ধকারে, আমি এই সামাজিক অন্ধকারে এই ঘোর দুর্দ্দিনে ক্ষুদ্র আলোকে আলোকিত করিতে চেষ্টা করিতাম? আছে-অন্ধকারে মাতিয়া আমোদ আছে। কেহ দেখিবে না-অন্ধকারে তুমি জ্বলিবে-আর অন্ধকারে আমি জ্বলিব ; অনেক জ্বালায় জ্বলিব। জীবনের তাৎপর্য্য বুঝিতে অতি কঠিন-অতি গূঢ় অতি ভয়ঙ্কর-ক্ষুদ্র হইয়া তুমি কেন জ্বল, ক্ষুদ্র হইয়া আমি কেন জ্বলি? তুমি তা ভাব কি? আমি ভাবি। তুমি যদি না ভাব, তুমি সুখী,-আমি ভাবি-আমি অসুখী। তুমিও কীট-আমিও কীট, ক্ষুদ্রাধিক ক্ষুদ্র কীট-তুমি সুখী,-কোন পাপে আমি অসুখী? তুমি ভাব কি? তুমি কেন জগৎসবিতা সূর্য্য হইলে না, এককালীন আকাশ ও সমুদ্রের শোভা যে সুধাকর, কেন তাই হইলে না-কেন গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতু নীহারিকা,-কিছু না হইয়া কেবল জোনাকি হইলে, ভাব কি? যিনি এ সকলকে সৃজন করিয়াছেন, তিনিই তোমায় সৃজন করিয়াছেন, যিনিই উহাদিগকে আলোক দিয়াছেন, তিনিই তোমাকে আলোক দিয়াছেন-তিনি একের বেলা বড় ছাঁদে-অন্যের বেলা ছোট ছাঁদে গড়িলেন কেন? অন্ধকারে এত বেড়াইলে, ভাবিয়া কিছু পাইয়াছ কি?

তুমি ভাব না ভাব, আমি ভাবি। আমি ভাবিয়া স্থির করিয়াছি যে, বিধাতা তোমায় আমায় কেবল অন্ধকার রাত্রের জন্য পাঠাইয়াছেন। আলো একই-তোমার আলো ও সূর্য্যের-উভয়ই জগদীশ্বরপ্রেরিত-তবে তুমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য ; আমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য।-এসো কাঁদি।

এসো কাঁদি-বর্ষার সঙ্গে, তোমার আমার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ কেন? আলোকময়, নক্ষত্রপ্রোজ্জ্বল বসন্তগগনে তোমার আমার স্থান নাই কেন? বসন্ত চন্দ্রের জন্য, সুখীর জন্য, নিশ্চিন্তের জন্য; বর্ষা তোমার জন্য, দুঃখীর জন্য, আমার জন্য। সেই জন্য কাঁদিতে চাহিতেছিলাম-কিন্তু কাঁদিব না। যিনি তোমার আমার জন্য এই সংসার অন্ধকারময় করিয়াছেন, কাঁদিয়া তাঁহাকে দোষ দিব না। যদি অন্ধকারের সঙ্গে তোমার আমার নিত্য সম্বন্ধই তাঁহার ইচ্ছা, আইস, অন্ধকারই ভালবাসি। আইস, নবীন নীল কাদম্বিনী দেখিয়া, এই অনন্ত অসংখ্য জগন্ময় ভীষণ বিশ্বমণ্ডলের করাল ছায়া অনুভূত করি ; মেঘগর্জ্জন শুনিয়া, সর্ব্বধ্বংসকারী কালের অবিশ্রান্ত গর্জ্জন স্মরণ করি ;-বিদ্যুদ্দাম দেখিয়া কালের কটাক্ষ মনে করি। মনে করি, এই সংসার ভয়ঙ্কর ক্ষণিক,-তুমি আমি ক্ষণিক, বর্ষার জন্যই প্রেরিত হইয়াছিলাম ; কাঁদিবার কথা নাই। আইস, নীরবে জ্বলিতে জ্বলিতে, অনেক জ্বালায় জ্বলিতে জ্বলিতে সকল সহ্য করি।

নহিলে, আইস মরি। তুমি দীপালোক বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মর, আমি আশারূপ প্রবল প্রোজ্জ্বল মহাদীপ বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মরি। দীপালোকে তোমার কি মোহিনী আছে জানি না-আশার আলোকে আমার যে মোহিনী আছে, তাহা জানি। এ আলোকে কত বার ঝাঁপ দিয়া পড়িলাম, কত বার পুড়িলাম, কিন্তু মরিলাম না। এ মোহিনী কি, আমি জানি। জ্যোতিষ্মান্ হইয়া এ সংসারে আলো বিতরণ করিব-বড় সাধ ; কিন্তু হায়! আমরা খদ্যোৎ! এ আলোকে কিছুই আলোকিত হইবে না! কাজ নাই! তুমি ঐ বকুলকুঞ্জকিসলয়কৃত অন্ধকারমধ্যে, তোমার ক্ষুদ্র আলোক নিবাও, আমিও জলে হউক, স্থলে হউক, রোগে হউক, দুঃখে হউক, এ ক্ষুদ্র দীপ নিবাই।

মনুষ্য খদ্যোৎ।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ১০৩ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন