রক্তের সিংহাসন।
রক্তের সিংহাসন।
মোঃ ফখরুল ইসলাম সাগর।

গল্প - রক্তের সিংহাসন।

মোঃ ফখরুল ইসলাম সাগর।
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫ রহস্য, স্বাধীনতা – মুক্তিযুদ্ধ

‎ভূমিকা:
কিছু রাত থাকে, যা কেবল সময়ের গর্ভে নয়— ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতেও লেখা হয়। সেই রাতে বাতাসও যেন বিশ্বাসঘাতকের নিঃশ্বাস বহন করছিল।

‎​প্রথম পর্ব: আঁধার রাত ও পতনের সুর
‎​রাজধানী ‘ফতেহাবাদ’, যা একসময় সূর্যের প্রতিচ্ছবি ছিল, তা হঠাৎই ঢেকে গেল অন্ধকারের বিষে। সুলতান রাফিদ আল-আমিনের প্রাসাদ ছিল ন্যায় ও শান্তির স্তম্ভ— কিন্তু সেই রাতেই, সেই স্তম্ভে ফাটল ধরল। প্রাসাদজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগ্নিকুণ্ডের লালচে ছায়া যখন আকাশের মেঘেও প্রতিফলিত হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন কোনো অশুভ শক্তি রাজ্যের আত্মাকে গ্রাস করছে।

‎​বিশ্বাসঘাতক উজীর, খালিদ-বিন-উসমান, তার লোভের শীতলতা নিয়ে আঘাত হানল। যে তলোয়ার এতদিন সুলতানের সুরক্ষা দিত, সেই খঞ্জরই গভীর রাতে তাঁর হৃদয়ে প্রোথিত হলো। রক্তের ধারা রাজদরবারের মহামূল্যবান মার্বেল মেঝেতে এঁকে দিল এক জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার মানচিত্র। সাম্রাজ্যের পতাকার রঙ রক্তে ধুয়ে গেল, আর জনগণ দেখল— তাদের প্রিয় সুলতান মাটিতে লুটিয়ে আছেন, নিস্তব্ধ, নিঃশাড়। সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল লাল ধূলোর মতো, কারণ ক্ষমতা তার কেন্দ্র হারিয়েছিল।

‎​কিন্তু বিধির লিখন অন্য ছিল। এই পতন দেখল না মরুভূমির ওপারের এক যুবক— রাফিদ আল-আমিনের পুত্র, যুবরাজ আজরান আল-দীন। সে বেঁচে ছিল, ভুলে গিয়েছিল রাজকীয় জৌলুস, কিন্তু ভোলেনি তার রক্ত, তার নাম।

‎​দ্বিতীয় পর্ব: নির্বাসন ও ইস্পাত-শাণানো প্রতিজ্ঞা
‎​আজরাণ তখন বহু দূরে, নক্ষত্র-আঁকা মরুভূমির কঙ্করময় পথে। তার রাজকীয় পোষাক বদলে গেছে ধূলিমাখা সৈনিকের পোশাকে। বছরের পর বছর সে কাটিয়েছে সূর্যের তেজ আর রাতের শীতলতা সহ্য করে, তার চোখে এখন আর রাজপুত্রের শৈথিল্য নেই— আছে এক শিকারীর স্থিরতা। সে জানে, এই নির্বাসন কেবল একটি সময়কাল ছিল, তার পরীক্ষার প্রান্তর।

‎​মরুভূমির প্রাচীন মঠগুলোতে সে খুঁজে নিল পুরোনো সেনাদলের শেষ স্পন্দন— যারা আজও সুলতান রাফিদের প্রতি অনুগত। সে তাদের ইস্পাতের মতো কঠোর প্রশিক্ষণ দিল, আর নিজের তলোয়ারকে শানিয়ে নিল সেই প্রতিজ্ঞার আগুনে— যে আগুন নীরব, কিন্তু দাহ্য ক্ষমতা অপরিমেয়।
‎​সে বারবার তার বাবার কথা স্মরণ করত, আর মনে মনে উচ্চারণ করত সেই নির্মম সত্য:

‎​“সিংহাসন কখনও দান নয়, তা শুধু উত্তরাধিকার নয়; তা ছিনিয়ে নিতে হয় রক্তের দামে— কেবল সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য।”

‎​প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে যেন সেই সিংহাসনের ওজন অনুভব করত। প্রতিটি আঘাতে তার তলোয়ার কেবল শত্রুকে নয়, নিজের ভিতরের ভয়কেও কেটে ফেলত।

‎​তৃতীয় পর্ব: ঝড়ের সংকেত ও রণক্ষেত্রের আহ্বান
‎​একদিন, মরুভূমির পশ্চিম দিগন্তে যখন শেষবারের মতো সূর্য ডুবে যাচ্ছিল, তখন আজরানের সৈন্যরা প্রস্তুত হলো। তারা সংখ্যায় কম, কিন্তু তাদের শিরায় প্রবাহিত হচ্ছিল প্রতিশোধের পবিত্র ক্রোধ। আজরান তার সৈন্যদের দিকে তাকাল— প্রতিটি মুখ যেন ইতিহাসের সাক্ষী, প্রতিটি চোখ যেন নতুন সূর্যের প্রত্যাশী।

‎​তার কণ্ঠে বাজল সেই বজ্রধ্বনি— যা কেবল একজন প্রকৃত নেতারই থাকতে পারে, যা মুহূর্তেই ভয়কে সাহসে রূপান্তরিত করে:

‎​“যে ভয় পায়, সে হারার আগেই মরে যায়। আজ আমরা মরতে আসিনি, আমরা এসেছি আমাদের সাম্রাজ্যের ঋণ শোধ করতে! আল্লাহর নামে, চলো!”

‎​ঢোলের প্রলয়নাচন শুরু হলো। অশ্বখুরের চাপা গর্জন ধূলোর স্তর ভেঙে আকাশ পানে ছুটে চলল। বাতাস আর মাটি কেঁপে উঠল, আর রাজ্যের প্রতিটি কোণে পৌঁছে গেল সেই যুদ্ধের বার্তা— রাজা ফিরে এসেছে।

‎​চতুর্থ পর্ব: রক্তাক্ত ধূলির যুদ্ধ
‎​ফতেহাবাদের বাইরের বিশাল প্রান্তর, যেখানে একসময় মেলা বসত, আজ তা হয়ে উঠল ধ্বংসের রঙ্গমঞ্চ— ‘রক্তাক্ত ধূলির রণক্ষেত্র’। বিশ্বাসঘাতক উজীর খালিদ প্রস্তুত ছিল, তার সৈন্যরা সংখ্যায় বেশি, কিন্তু হৃদয়ে ছিল দুর্নীতি ও ভয়।

‎​লোহার আঘাতে গর্জে উঠল ভূমি। আজরানের সৈন্যরা উন্মত্ত ঝড়ের মতো আঘাত হানল। তলোয়ারের ঝলকে সৃষ্টি হলো আলোর শিখা, আর সেই শিখায় স্পষ্ট হলো— আজ ন্যায় বনাম অন্যায়ের সরাসরি দ্বন্দ্ব।

‎​আজরাণ নিজেই ছিল এই যুদ্ধের মূল শক্তি। সে শত্রুর ব্যূহের মাঝে প্রবেশ করল সিংহের মতো। তার হাতে তলোয়ার কেবল অস্ত্র নয়, যেন ছিল আল্লাহর ক্রোধের প্রতীক। একে একে পড়ে গেল খালিদের প্রধান সেনাপতিরা, যারা অর্থের লোভে রাজ্য বিক্রি করেছিল। তাদের রক্তে রাজপথ ধুয়ে গেল।

‎​অবশেষে, আজরান মুখোমুখি হলো খালিদের। উজীর তার শেষ অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ছিল ক্ষণিকের, কিন্তু তা চিরকালের। আজরান তার তলোয়ারের এক আঘাতে খালিদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকড় উপড়ে ফেলল। খালিদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, তার চোখে ছিল বিস্ময়— যে ক্ষমতা সে ছিনিয়ে নিয়েছিল, তা এমন দ্রুতই বিলীন হয়ে গেল।

‎​পঞ্চম পর্ব: মুকুটের ভার ও সিজদার আহ্বান
‎​সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আকাশের অগ্নিমেঘের নিচে, আজরান একা দাঁড়িয়ে রইল রাজপ্রাসাদের চূড়ায়। তার তলোয়ার থেকে তখনো টপটপ করে রক্ত ঝরছে, শেষ সূর্যের আলো তাতে ঝিলিক দিচ্ছে। সে ক্লান্ত, তার শরীরে গভীর আঘাত, কিন্তু তার আত্মা অবিচল।

‎​ধীরে ধীরে সে সিংহাসন কক্ষের দিকে হেঁটে গেল। সিংহাসন— যা একসময় স্বর্ণালী ছিল, আজ তা রক্তের আভা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তা স্পর্শ করল না, তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

‎​সে জানত—

‎​“একটি মুকুটের ওজন কেবল সে-ই জানে, যে মাথা তা বহন করে। এই ওজন স্বর্ণের নয়, এই ওজন হল হাজারো মানুষের জীবন আর তাদের আশার।”

‎​আজরাণ সিংহাসনে বসল। মুকুট পরল না, কেবল মাথা নত করে কাঁদল। ঠিক তখনই, মসজিদের মিনা থেকে ভেসে এলো মাগরিবের আজানের ধ্বনি— যা যুদ্ধের রক্তকে পবিত্রতার সুরে ধুয়ে দিল।

‎​সিংহাসনে বসে, আজরান তার হাতজোড় করে, নতুন সুলতান সিজদায় নত হয়ে উচ্চারণ করল— গভীর আবেগ ও আত্ম-সমর্পণের এক প্রার্থনা:

‎​“হে আল্লাহ, যদি এই রক্তে আমার ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ছায়া থাকে— তবে আমার রাজত্ব শুরু হওয়ার আগেই মুছে দিও। আর যদি এতে তোমার দেওয়া ন্যায়ের প্রতিজ্ঞা থাকে, তবে এই সিংহাসনকে দাও আশীর্বাদ। এই ক্ষমতা আমার নয়, তোমার আমানত।”

‎​প্রজারা, যারা লুকিয়ে ছিল ভয়ে, তারা বেরিয়ে এলো। তারা হাঁটু গেড়ে চিৎকার করে উঠল—

‎​“আল্লাহু আকবার! সুলতান আজরা আল-দীন দীর্ঘজীবী হোন!”

সেই রাতে ফতেহাবাদে নতুন ইতিহাস শুরু হলো। রক্তে লেখা হলো এক সাম্রাজ্যের নতুন নাম, আর ন্যায়ের আগুনে গড়া হলো এক নতুন সূর্য। ক্ষমতা ফুল নয়, আগুন— আর আজরান তা ধরতে জানে। সে শুধু রাজা নয়, সে এক বিপ্লব।

পরে পড়বো
১২০
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন