প্রবাসীর ব্যাথা
প্রবাসীর ব্যাথা
মানব মন্ডল

গল্প - প্রবাসীর ব্যাথা

মানব মন্ডল
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ জীবনবাদী, ভালোবাসা

প্রবাসী জীবন মানে অনেক টাকা। কথাটা ঠিক নয়। প্রবাসী জীবনে সময় কম। কারণ আমরা 12 ঘন্টা কাজ করি। ভারতে ৮ ঘন্টা। আর এ জন্য ও শরীর দূর্বল থাকে। আমাদের কাছে অনেক টাকা থাকলেও ভালো খাবার খেতে পারে না। কারণ আমরা রোজগার করি বৌ ছেলে মেয়েদের জন্য। নিজের জন্য খরচ করে না। এই দেখুন না আমিই। আজ প্রায় তিন দিন পর ফোন করার সুযোগ পেলাম বাড়িতে। ফোনটা একলব্য দৌড়ে গেলো মায়ের কাছে। ও কথা বলতে শিখে গেছে। কি সুন্দর স্পষ্ট বললো ” দিদুন, জ্যাঠার ফোন তারাতারি ধরো”
মায়ের সাথে টুকু টাক কথা হললো, মা বললো ” তুই ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে আয় আমাদের জন্য কিছু আনতে হবে না। অত টাকা পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না “…
ছোট একলব্য কি বুঝলো জানি না। ফোন টা হাতে পেতেই বলল ” আমার জন্যেও লান গাড়ি আনতে হবে না। আমার অনেক গাড়ি আছে। তুমি বাড়ি এসো জ্যাঠাই। ”
আমি আপনাদের ভাষায় প্রবাসী। আবুধাবি অফসোর তেলের খনিতে কাজ করি। অফশোর তেলের খনি হল সমুদ্রের গভীরে অবস্থিত তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্র, যা গভীর জল খনন (deepwater drilling) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তোলিত হয়.
গভীর জলের ড্রিলিং রিগ (drilling rig) ব্যবহার করে সমুদ্রের গভীরে গর্ত তৈরি করা হয়. তারপর পাইপলাইন তৈরি করে তেল উত্তোলন করা হয়। এই পক্রিয়া চালিয়ে যেতে বিভিন্ন পরিকাঠামো তৈরি করতে হয়। সমুদ্রের মাঝে তৈরি হয়, প্লাটফর্ম, কমপ্লেক্স, আইল্যান্ড, থাকে বার্জ রিজ, জাহাজ। সমুদ্রের মাঝে থেকে এরা কাজ করে মাসের পর মাস।
তেল খনি থেকে নানা রকম বিষাক্ত গ্যাস বেরায়, এদের স্বাস্থ্য দিকে তাকিয়ে আমাদের ছুটি হয় তিন মাস পর পর। ৯০ দিনের একদিন বেশি কাজ করতে দেওয়া হয় না এখানে। আসলে টানা কাজ, সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত বন্দী জীবন, এক লোক জনের সাথে কথা বার্তা, এক ঘেয়ে জীবন যাপন শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি করে। তাই ছুটি যাওয়া বাধ্য তা মুলক।
নিয়ম থাকলে তার ভাঙার উপায় তৈরি থাকে।  ৯০ দিন হবার আগেই আপনি যদি ডাঙায় যান এক দুই দিনের জন্য, তাহলে আবার আপনি আপনার শ্রম বিক্রির সুযোগ পাবেন।আমি এবার তাই করেছি। আসলে এই রকম করলে, আপনি বেশি টাকা আয় করতে পারেন। যদিও আমি খুব কম মাইনেতে কাজ করি। তাই মাইনে অনুসারে আমি ২০০০০ টাকা বেশি পাবো। বাড়ির লোক এই সিদ্ধান্ত মানতে পারছে না। কারণ ছয় বছর পর এই বার আমি দূর্গা পূজাতে বাড়ি থেকে অন্য সদস্যদের সাথে পূজাতে আনন্দ করতে পারতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের পরিবারের অনেক টাকার দরকার।
ভাই বেশে রাগ করছে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাই বৌ রূপা বললো ” দাদা আগের বারে, তুমি দিনেশকে রিলিজ করতে এক সপ্তাহ বেশি থাকতে গিয়ে, 15 মাস বাড়ি ফিরতে পারো নি মনে আছে তো। আর আজ তোমার জীবন বদলে গেছে ঐ 15 মাসটার জন্য মনবে তো। তুমি বললো অফসোর লাইভ কোন ভরসা নেই। তুমি চলে এসো তারা তারি। ”
দিনেশের নামটা শুনেই মনটা ভারি হয়ে গেলো। ওরা গুজরাটি । ওর বাবা ওর মাকে মুম্বাই এসে বিয়ে করে। অগুজরাটি আমীস ভজনকারি কেরলা মেয়েকে বিয়ে করায় আত্মীয় স্বজনদের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ব্যাবসায় অনেক ধার দেন হবার পর, ওর বাবা আত্মহত্যা করে। তখন ও খুব ছোট। ওর মা ওকে মানুষ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়িয়ে এই বিদেশে চাকরি পাঠায়।

হঠাৎ করেই ওর মা মরা যায়। আমার ভালো বন্ধু ছিলো ও।  আমাদের অফসোর এক মাত্র বাবা মারা গেলে এমারজেন্সি ছুটি পাওয়া যায়। লোক ছিলো না সেই সময়। আসলে কম্পানি অফসোরে কাজ করা বন্ধ করবে বলে ঠিক করছিল। কারণ আমরা ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানি। জাহাজ করেই খাবার দাবার সাপ্লাই করতে হয় রিগ, বার্জ, প্লাটফর্ম গুলোতে। কিন্তু রাফ সি জন্য জাহাজ পরিসেবা ব্যাহত হতো। জাহাজ কন্টেইনার বেশি মাল নষ্ট হয়ে যেতো। আর রিগ বার্জ গুলোতে স্টোর ছোট হওয়ায় বেশি মাল মজুত সম্ভব হতো না। ফলে ক্লাইন্টকে সঠিক পরিসেবা দিতে পারছিলো না। তাই অফসোর কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। আর ভুগতে হতো আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।
যেদিন ওর মায়ের মৃত্যু সংবাদ পায়। আমার সেই দিন টিকিট ছিলো ভারতে ফেরার। আমার ফেরাটা জরুরি ছিলো কারণ তিথির সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিলো। দুই সপ্তাহ পর আমাদের বিয়ে ছিলো। কিন্তু দিনেশকে অফিস থেকে বললো ওকে ভারতে যেতে দাও হবে না। কারণ ওর রিলাভার নেই। ও বললো, তেরো দিন নয়। শুধু মাত্র মুখে আগুন দিয়ে চলে আসবে। তাই আমি ওর রিলিভার হলাম সাতদিনের জন্য। কিন্তু সাত দিন থাকাটা আমার জন্য কাল হয়ে গেলো। হঠাৎ করোনা প্রকোপ বেড়ে গেলো। লকডাইন আটক গেলাম আমি 15 মাসের জন্য।
এই আটকে যাওয়া ফলে আমার বিয়েটাও ভেঙে গেলো। তবে দুঃখ হয় দীনেশ জন্য, ও ফিরতে পারলো না সৌদিতে। অফিস অবশ্য ওর সেটেলমেন্ট চেক পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আর ওর চেক দিতে গিয়ে ওর বাড়িতে আমরা ওর বেয়ারিস লাস টা পাই। ওর চোখ দুটি খুব সুন্দর ছিলো। কিন্তু ওরলাসের চোখ দুটো পিপড়াতে খেয়ে নিয়েছিলো।

তবে জানেন তিথির চোখ দুটো ও খুব সুন্দর ছিলো পুরোপুরি পটল চেরা চোখ যাকে বলে। কাজল পড়লে আরো মায়াবী লাগে ওর চোখ। ছয় বছর আগে ওর সাথে পূজাতে ঘুরে ছিলাম শেষ বার। আমরা যার প্রবাসে চাকরি করি। সাধারণত তারা  বাড়িতে অতিথি মতো থাকি। কিন্তু আপনজনের সুখে আমরা সুখী হতে চাই , তাই আমরা নিজেদের জন্য কিছু করি না। তিথি সে বছর জোর করে আমাকে দিয়ে আমার জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কাপড়, রৌদ্র চসমা, জুতো কিনিয়ে ছিলো। এখন সাইন ইন আর সাইন অফ দিন আমি ওগুলো পরি।

আমরা খুব গরীব ছিলাম। তবে ঈশ্বরের কৃপায় চাকরি হলো বাবার। কুড়িটা  বছর আমরা একটা দশবাইদশ  ভাড়া ঘরে, কাটিয়ে ছিলাম। তারপর লোনকরে বাড়িটা করা হয়। বাবা লোন শোধ করেছে। বাড়িটা সাজানো দায়িত্ব আমি নিয়েছি। বাবার গরমে খুব কষ্ট হয় বয়স হয়েছে। তাই ফিল্ড ব্যাকটা নিলাম। বেচে থাকলে তো পূজা অনেক দেখতে পাবো। কিন্তু এইবার গরম পড়া আগেই বাবার ঘরে এসি লাগাতে চাই। তাই ফিল্ড ব্রেক নিয়ে বোধহয় ভুল করি নি।

আসলে বাবা কত দিন বাঁচবে সেটা প্রশ্ন নয়। অফসোরে চাকরিটা অনেকটা ঝুঁকি পূর্ণ। তাই সব সখ আল্লাদ তারাতারি পুরণ করতে চাই। ২০২৪-এ কুয়েতের একটি ভবনে আগুন লেগে প্রায় ৪৫ জন ভারতীয়সহ ১৯৫ জন অভিবাসী শ্রমিক মারা যান। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটই এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ বলে জানানো হয়েছিল, যা নিরাপত্তা লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল।এই খবর সবাই জানতে পরেছেন আপনারা। কিন্তু অফসোরে এই রকম ঘটনা ঘটলে সেই খবর জানতে পাওয়া যায় না। ভারতের মুম্বাই হাই কয়েক বছর আগে একটি রিগের সাথে একটি সাপ্লাই ভেসেলে ধাক্কা লাগে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায়। ফলে কিছু মানুষ বেচে ফিরতে পেরেছিলেন এই ঘটনার পর। কিন্তু এই খবর টা কোন মিডিয়াতে বলাও হয়নি। তাই অনিশ্চিত জীবনের বিনিময়ে নিশ্চিন্ত একটা জীবন আমরা উপহার দিতে চাই প্রিয় মানুষদের।

পরে পড়বো
৮৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন