একদা কাশীবাসিন্য এক প্রেমিকা, নিঃস্বার্থ স্নেহমাধুর্যে,অভাবনীয় স্নেহে, বিমুগ্ধ এক শীর্ণ ও শীতল সর্পকে দুধ-কলা দান করিয়া পরম সহিষ্ণুতায় করুণাভরে লালন করিল।প্রেমিকা বলিল,
“আয় গো শীতল দীন,
তুই হবি আমার হৃদয়ের রাজসিংহাসনের অধীন!”
সে সর্প:
যাহার নয়ন ছিলো করুণ,মুখচ্ছবি ছিলো শিশুর ন্যায় ক্ষীণ,যাহা কাঁপিয়া কাঁপিয়া দেহের আবরণ খণ্ডন করিত, তাহাকে প্রেমিকা আশ্রয় দিল আপন হৃদয়ের কপাটমুক্ত প্রাঙ্গণে।প্রেমরস সিক্ত হৃদয়ে, যে ছিল পরিত্যক্ত, তাহারে দিল পূর্ণ স্নেহাশ্রয়।ভগ্ন ডানা মেলিয়া সর্প, তাহার জীবনের সুধানিধিতে আশ্রয় পাইল…
নিঃস্ব, নিরুপায় প্রেমিকা তাহারে হৃদয়পটে কল্পিল “সহচর”!দয়ার পরাকাষ্ঠায় সে তাহার বক্ষে বাহির হইয়া হৃদয়ের অন্তঃপুরে রাখিল –
স্নেহস্নাত করিয়া পোষিল এক নিষ্ক্রিয় হিংস্রতাকে, যেন সর্প নয়, অপত্যস্নেহপ্রাপ্ত গর্ভজাত সন্তান!
সময়ের হঠাৎ বক্রচক্রে সেই সর্পে উৎপন্ন হইল বাক্যশক্তি,কণ্ঠস্বর প্রাপ্ত হইল –
মৌনতার ছায়া ভেদ করিয়া তাহার স্তব্ধ জিভ হইতে ফুটিল বিষাক্ত ব্যঞ্জনার স্ফুলিঙ্গ!উচ্চারিত হইল বিষবাক্যের বিষম উচ্চারণ।প্রেমিকা বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়া শ্রবণ করিল; সর্প বলিল –
“হে প্রেমিকা…!
তোমার কোমলতা করিয়াছে আমাকে দুর্বল,
এইবার আমি শক্তিমান হইব,
সুতরাং,
তোমায় করিব আজি দংশন:
ইহা আমার একনিষ্ঠ দৃঢ় মনোবল!”
হঠাৎ এক দিবসে, বসন্তের গ্রীষ্মানুভূত বেলা শেষে,প্রেমিকা নিশীথে তাহারে করিল আলিঙ্গন -নির্ভীক নিঃস্বারে,
কিন্তু সর্প! হায় সর্প! তাহার অমায়িক করুণ কোমল বক্ষদেশে ছোবল হানিল এক বিষদন্তধারে…!
প্রেমিকা ধ্বস্ত হইয়া জিজ্ঞাসিল,
“হে হৃদয়-মথিত প্রভু!“
এ কেমন পুরস্কার, হে প্রিয়?”
কাহারে করিলে তুমি শত্রু?”
পুনশ্চ সে শুধালো :
অবাক হইয়া,
“কেন এ মর্মান্তিক ছল?”
“এ কেমন খেলা?”
“হে সর্প!”
কাঁদিয়া কহিল প্রেমিকা,
“তোমারে দুধ দিলাম, কলা দিলাম,
মোর হৃদয় দিলাম পূর্ণ করিয়া –
তুমি বিষে কেন ভাসালে গরল?”
সর্প হাসিয়া বলিল –
“ভুল হইয়াছে,
ভুলে হইয়াছে,
ভ্রান্তি হইয়াছে,
ভুল বশত ছোবল পড়িয়াছে,স্বভাবতই চলিয়াছে!”
“মম দোষ নহে,
শব্দে শব্দে ব্যথা,
বিষে নহে কণিকা,
তবু করো ক্ষমা!”
“হে নারীরূপিণী মায়া!
বিষ নয়, এ ছিল শব্দবাণ!”
“তুমি তো প্রণয় এর সহিত পরিণয় চেয়েছিলে পরম ভক্তিতে,
তাই তোমার রাজ্যে আমৃত্যু স্থান লাভ করিয়াছে বিষাদের মেলা!”
ভুলের আবরণে ঢাকিল হৃদয়ভেদের পঙ্কিলতা।
প্রেমিকার বক্ষে বিষাক্ত ব্যথার উদ্গার, অথচ যৌনতা ছিল না তাহার প্রতিদান।ভালোবাসা লইয়া যে করিয়াছে বাণিজ্য, সে তো শঠতায় সিদ্ধ হইয়াছে!
তাহার চক্ষুপুটে লজ্জার ছায়া এক বিন্দু অধিষ্ঠান লাভ করিল না।কর্তব্যচ্যুতি লাঘব করিয়া নিজ দোষে তাহা লজ্জা বিবর্জিত রহিল।
কালান্তরে সেই সর্প, আপাতত দন্তবিকিরণ করিয়া, জনপদে গমন করিল। জনসমাজে বাজারের ভীড়ে করিল ধ্বংসাত্মক শব্দবর্ষণ –
নির্দ্বিধায় প্রেমিকাকে করিল কটাক্ষ, হেয়, উপহাসের পাত্রী।তাহার জবান হইতে বিপুল জনারণ্যে কর্ণবিদারী কুৎসার বীজ বপন করিল।
প্রেমিকাকে, যিনি তাহাকে প্রেমপ্রীতির আর্দ্র বীজে পুষিয়াছিলেন,যে ছিলো তাহার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, তাহারে করিল ‘ক্ষ্যাত’, ‘কপটিনী’,’ভানুমতী’, ‘চরিত্রহীনা নাট্যবতী’ ইত্যাদি অভিধানে অবনমিত।
কুৎসা করিল সে হাসিয়া, বিদ্রূপের পণ্যে।
“সে নারী”
বলিল সে –
“অভিনয় জানে,
নাটক খেলে,
অশ্রুজলে কদম্ব বনে!”
লোকবদ্ধ হইল গুঞ্জনকথায় –
“সে নারী প্রেমিকা নহে,
চাতুর্যপ্রবণ চমৎকারিণী,
এক অপ্রতিম বিভ্রান্তিকা!”
রটানো হইয়াছে –
“সে ছলনাময়ী,
বাকচাতুর্যে বিভ্রান্তিকা অতি।”
লোক হেসে উঠিল – ব্যঙ্গ ছুঁড়িল, কলঙ্কে জড়াইল প্রেমিকার শাড়ি,তবু সে হেসে বলিল না কিছু, সহিল প্রহসনের ভারি।
তাঁর কণ্ঠে নিঃশব্দ আর্তি, চোখে নিরবতা, মুখে হাসির নকশা,তবু অন্তরে ছিল – ভগ্ন হৃদয়ের অনুচ্চারিত ভাষা।সেই প্রিয়তমা ‘অত্যন্ত’ হইতে হঠাৎ ‘অতিশয়’ হইয়া উঠিল : উপহাসের ব্যঞ্জনায় অপমানিত!
প্রেমিকা নীরব রহিল। হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া জ্যোৎস্নাহীন পাষাণে পরিণত হইল।হৃদয় ভাঙিল, অশ্রু শুকাইল, নিঃশব্দে,অবশেষে সেই ভগ্ন কঙ্কালে কষ্ট জুড়াইল বিষণ্ণ নিবিড়ে।বক্ষদেশে যাহা ছিল প্রেমের নদীমাতৃকতা, তাহা হইল রক্তহীন মরুভূমি।কিন্তু হায়, নারীচরিত্র রহস্যময় গাঙ্গেয়া –
কালের অনুগ্রহে তাহার হৃদয় পুনঃ জোড়ালো, মলিন জোৎস্নায় রূপ পেল স্নেহের স্নিগ্ধতা।
আর সর্প?
পুনরায় ফিরিল সর্প, আসন পাতিল হৃদয়ের মন্দিরে,
মনে করিল –
“এ প্রেমিকা তো ক্ষমার প্রতিমূর্তি পুরাণে।”
সে জানিল না – নীরবতাই কখনো কখনো অভিশাপ,
যা সর্পকুলের গর্ভে পুষে রাখে প্রতিহিংসার জ্বালাময় শাপ।দংশনকারী সেই সর্বভক্ষক, ক্ষমার অঙ্গন বিচরণ করিল অবলীলায়।আলতার ছোঁয়া বক্ষে কাষ্ঠরূপে রক্তস্নান ঘটিল।
প্রেমিকা ভাবিল, “হয়ত এবার বুঝিল সর্প মোর অন্তর,”
কিন্তু সে জানিত না –
কৃতঘ্নের কূটচাল হইতে মোহ যে সর্বঘাতী স্বর!
প্রেমিকা আবার তাহারে স্থান দিল হৃদয়ের এক কোণে –
এ যেন প্রেম নয়, আত্মঘাতী ধ্যান; নয় স্নেহ, বরং হইতেছে আত্মদাহের পূর্বাভাস।তৃপ্ত হইল তাহার ক্রূর আত্মা, যাহা কৃতঘ্নতায় কুশলী, আর ক্ষমায় পিপাসিত।
একদা এক শব্দচারী, নিরালায় লিপিকার এর আবির্ভাব ঘটলো।এক নিভৃত স্থানে আসন গ্রহণ করিয়া এক ব্যঙ্গপ্রিয় লিপিকার বসি বসি লিখিল এই কাহিনী রহস্যময় ব্যঙ্গরসে –
লিখিল:
“অপাত্রে দানকৃত স্নেহ,
যেমন খলজনে দানকৃত শাস্ত্র,
পরিণামে আনে দংশন, অপমান, ও রক্তক্ষরণ!”
পুনশ্চ:
“যে প্রেম অন্ধ,
তাহাতে পুষিত হয় বিষধর;
যে স্নেহে বিচক্ষুতা নাই,
তাহা জন্ম দেয় ছলনাময়ী আত্মঘাত!”
লিপিকার এক কোণে বসি রহস্যে হাসিল,
কলম দুলায়ে ব্যঙ্গতৃপ্ত বচন রচিল।লিখিল –
“স্নেহে যদি বিবেচনা না মেলে,
প্রেম হইয়া ওঠে মৃত্যুর ছদ্মবেশে খেলে!”
“সর্প নয় শুধু সর্প,”
সে লিখিল,
“এ এক চিহ্ন,
যা প্রেমিকার সরলতায় ঘটায় হৃদয়-বিধ্বংসীয় যজ্ঞ।”
“আর প্রেমিকা?
সে রহিল ছায়ায় নির্বাক,
প্রেম নয়,
যেন আত্মার নিঃশ্বাসহীন চিতাভস্মভূমির ডাক।”
শেষ দিবসে আসিয়া,ব্যাকুল হইয়া, তদবধি গোপনপ্রবাহে এক শব্দজীবী ক্ষীণ কলম দুখণ্ডে কথার গাথা লিখিল।
তাঁহার কালির সহিত মিশাইয়া প্রেমিকার রক্ত, সর্পের বিষ,যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা –
লিখিল,
“এ জগতে সর্প নাহি কেবল সরীসৃপ মাত্র,
ইহা এক প্রতীক –
ধূর্ততা, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মমোহে মোহাবিষ্ট যন্ত্র।”
প্রেমিকা:সে রূপ নয়, সে শ্রদ্ধা নয় – সে এক অন্ধ আস্থা, ত্যাগের মিনার,যাহার ভিত্তি যুগে যুগে কাঁপিয়া উঠে,তবুও পতিত হয় না!তাঁহার হ্রস্ব হাসি এক মহাসংকেত,যাহা বলে –
“আমার কান্না নয়,
তোমার পাপ ইতিহাসই হবে লেখ্য!”
সেই আঁখি দুটি -যুগযুগ ধরে সাক্ষী,
যে প্রেমিকার বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসের মূল নীচে চাপা পড়িয়াছে ঠিকই,তবু সে যে প্রেম করিয়াছিল,
তার গভীরতা অনন্ত…তাহার নিঃশব্দ আত্মবিসর্জন, তাহার নির্বোধ ক্ষমা, তাহার প্রেমের ঘনঘোর বিষণ্নতা!
আর সর্পের ব্যাখ্যা -সামান্য ছায়া, সাময়িক ধোঁকা!
এই কাহিনীর সর্প শুধু এক সত্তা নহে -প্রতীক হিংসা, প্রতারণা, স্বার্থান্ধতার।
পরিশেষে,বলা বাহুল্য…
অতএব, প্রেমিকা হইল এক নৈর্ব্যক্তিক তপস্যার প্রতিমা,
যাহার অন্তঃস্থিতি ক্লেদাক্ত করুণা ও নিঃশব্দ আত্মাবলি।
তাহার হৃৎকম্পন ছিল অগ্নির হিমশিখা,
যাহা স্পর্শে শীতল, প্রহারে দগ্ধ।
সেই সর্প -সে কেবল এক দংশক নয়,
সে এক পৌরাণিক প্রতীক,
যাহা মোহের আবরণে করিয়া বিচরণ,
সত্যকে মিথ্যার বেশে করিয়া রয় অলঙ্করণ!
সে প্রেম নয়,
যাহা বিচারবোধহীন নতজানু হৃদয়ে সঞ্চিত হয়;
তাহা এক আত্মঘাতী লীলাচিত্র –
যাহার ক্যানভাসে ছড়ায় নিঃসঙ্গ আত্মার নিঃশেষ ধ্বনি!
দ্রোহ!
দুগ্ধসর্পের দ্রোহ –
এ হইল প্রেমের ছদ্মবেশে আত্মমোহের মহাভারত,
যেখানে স্নেহ, করুণা ও আত্মত্যাগ;
হস্তলিখিত হয় :
রক্ত, বিষ ও কলঙ্কের কালিতে!
অতঃপর কালের রেখায় লিপিবদ্ধ রহিল এক সতর্ক বাণী:
“অন্ধ স্নেহে নিক্ষিপ্ত হৃদয়,
সর্পসম প্রতিক্রিয়ায় দগ্ধ হয়;
আর ক্ষমা,
যদি বোধহীন হয়,
তাহাকে আত্মার অবসাদযাত্রা লোকে কয়!”
লিপিকার কলম থামাইল শেষ বেলায়,
লিখিল –
“যে প্রেমিকা দংশনে হাসে না,
কান্নায় ভাঙে না,
সে হৃদয় নয় –
সে চিতার শিখা,
যা আপন আঘাতে নয়,
অপরাধীর অন্তঃজ্বালা জ্বালায়…!
“যে হৃদয় বারবার ছিন্ন হয়, তাহাতে কি পুনরায় প্রেম জন্মায়?”
“নাকি তাহা এক আত্মধ্বংসী প্রহসনের চিত্ররূপ…?”

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন