অরিত্রি নৈরীতি

কবিতা - দুগ্ধসর্পের দ্রোহ: অন্ধস্নেহ ও কৃতঘ্নতার মহাভারত ২

অরিত্রি নৈরীতি

অন্তিম দিবসের সান্ধ্যকালে,
একাকিনী প্রেমিকা প্রবল ব্যাকুলতাপূর্বক উচ্চারিল একটিমাত্র বাক্য –

“হে সর্প! তুমি নহে কেবল বিষধর, তুমি পরিণত হইয়াছিলে মম কল্পনাতীত করুণাভাসিত মহাকাব্যে। তোমার দংশনে জড়ায় নি মম প্রাণ, উদিত হইয়াছে এক অলিখিত শাশ্বতযন্ত্রণার নির্ঘোষ, যাহার বহিঃপ্রকাশ বেশ নিষ্প্রাণ…!”

তাহার অধরে ছিল না আর প্রলাপ, ছিল না ক্রোধানল বা অভিশপ্ত আক্ষেপ, ছিল কেবল অন্তঃসলিলা এক প্রাগৈতিহাসিক বিষণ্ণ অশ্রুধারা, যা গ্রীষ্ম সন্ধ্যার বিবর্ণ অলকতরু-গগনে নিঃশব্দে মিশিয়া গিয়াছিল!

চন্দ্রপুষ্ট সেই লঘুমসৃণ জ্যোৎস্নায় প্রেমিকার মুখখানি প্রতিভাত হইল মৃত্তিকাময় গম্ভীর পবিত্রতায়, যেন সে নারী নয়, বরং যেন এক করুণ প্রতিমূর্তি, যাহার মৃদু প্রসন্নতাও রহস্যময় শোকপ্রভায় দীপ্তিময়।

আর সর্প? সে নতশির হইল না, কেবল পুনরুচ্চারিল আত্মপক্ষ সমর্থনের এক অনুরণিত শ্লোক –

“আমি যেমন ই জন্মজাত,
তেমনিই মম স্বভাব –
আমি সর্প,
মম অঙ্গে দুধ গড়াইলেও,
অন্তরে আমি বিষ ধারণ করিয়া বাঁচি।
আমারে দোষারোপ করিও না,
তুমি তো পূর্ব হইতেই অবগত ছিলে…!”

প্রেমিকা নীরব রহিল; তাহার হৃদয়ের অভ্যন্তরে আঁকিয়া ফেলিল এক অদৃশ্য চক্র – যাহার কেন্দ্রে ছিল বিশ্বাসভঙ্গের কালমেঘ, আর পরিধিতে বিস্তৃত ছিল এক অনন্ত ক্ষমার রূঢ় গগন।

সেই রজনী, তাহার শব্দশূন্য দীর্ঘশ্বাসে গঠিত হইল এক নূতন পদ্যবিন্দু – “ভ্রান্তপ্রেমিক ও বিষাক্ত স্নেহরঙ্গ! ”

সে কাব্য শুধু প্রেমিকার আত্মজৈবনিক নয়, বরং এক বিপুল সতর্কবার্তা -সকল সেই সরল নারীদের প্রতি নিবেদিত, যারা সর্পকুলকে সন্তানরূপে বক্ষে ধারণ করিয়া দেয় হৃদয়তরল, আর প্রতিদানে লাভ করে –

দংশনের বিষ, নিন্দার কণ্টক, কুৎসার ছায়া, আর এক দীর্ঘ ও নিঃশব্দ অন্তর্জাগতিক মৃত্যুমালা!

তবুও প্রেমিকা বাঁচে, কারণ তাহার প্রেম ছিল নির্মল সত্য। সর্প ও মরে না, সে বাঁচে কথার প্রতিধ্বনিতে, ছলনার ব্যঞ্জনায়।

কিন্তু কাহিনী? সে বাঁচে লিপিকার কলমে, যেখানে ব্যঙ্গ হাসিয়া উঠে, আর বেদনা চিরন্তন সত্য লিখিয়া যায়, নিভৃত নিবেদনরূপে!

লিপিকার অন্তিম তিক্ত সত্যতার বাণী:

যাহারা অন্ধ হৃদয়ে সর্পে মমত্ব খুঁজে,
তাহারা স্বহস্তে আত্মার অগ্নিসংস্কার করে!”

“দংশন হইল তাহাদের নিত্যবরণীয় নিয়তি,
যাঁহারা হৃদয়ের অর্ঘ্য লঘু ছলনাকেও নিবেদন করে!”

“সততা, যদি ছলনার প্রেমে আত্মসাৎ হয়,
তবে তাহা নিজের প্রতিচ্ছবিকেই বিষরস দান করে!”

“ক্ষমা, যদি বিচারবুদ্ধিহীন হয়,
তবে তাহা দয়ার প্রকাশ নহে –
তাহা এক ধূসর আত্মসমর্পণ,
যাহার পরিণাম হইল অনন্ত অপমানের আত্মজলাধি!”

“প্রেম, যদি নিজের পরিচয়ে অনড় না থাকে,
তবে সে প্রেম নহে –
সে হইল আত্মপরিচয়হীন এক অপূর্ণ যন্ত্রণাবিন্দু!”

“সর্পকে যিনি পূজার অনলে স্থাপন করেন,
তাঁহার প্রার্থনায় জ্বলে না প্রদীপ –
জ্বলে আত্মার দহন।”

পরে পড়বো
২৩৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন