রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - পরশপাথর

লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
মাথায় বৃহৎ জটা ধুলায় কাদায় কটা ,
মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর ।
ওষ্ঠে অধরেতে চাপি অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে ।
দুটো নেত্র সদা যেন নিশার খদ্যোত-হেন
উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে ।
নাহি যার চালচুলা গায়ে মাখে ছাইধুলা
কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন ,
ডেকে কথা কয় তারে কেহ নাই এ সংসারে
পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন ,
তার এত অভিমান , সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান ,
রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর ,
দশা দেখে হাসি পায় আর কিছু নাহি চায়
একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!

সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার ।
তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি হেসে হল কুটিকুটি
সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার ।
আকাশ রয়েছে চাহি , নয়নে নিমেষ নাহি ,
হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে পূর্ব গগনের ভালে ,
সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ ।
জলরাশি অবিরল করিতেছে কলকল ,
অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে ।
কাম্য ধন আছে কোথা জানে যেন সব কথা ,
সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে ।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি , মহা গাথা গান গাহি
সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর ।

কেহ যায় , কেহ আসে , কেহ কাঁদে , কেহ হাসে ,
খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।

একদিন , বহুপূর্বে , আছে ইতিহাস —
নিকষে সোনার রেখা সবে যেন দিল দেখা —
আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ ।
মিলি যত সুরাসুর কৌতূহলে ভরপুর
এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে ।
অতলের পানে চাহি নয়নে নিমেষ নাহি
নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে ।
বহুকাল স্তব্ধ থাকি শুনেছিল মুদে আঁখি
এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন ;
তার পরে কৌতূহলে ঝাঁপায়ে অগাধ জলে
করেছিল এ অনন্ত রহস্য মনথন ।
বহুকাল দুঃখ সেবি নিরখিল , লক্ষ্মীদেবী
উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর ।
সেই সমুদ্রের তীরে শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।

এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ ।
খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু বিশ্রাম না জানে কভু ,
আশা গেছে , যায় নাই খোঁজার অভ্যাস ।
বিরহী বিহঙ্গ ডাকে সারা নিশি তরুশাখে ,
যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা ।
তবু ডাকে সারাদিন আশাহীন শ্রান্তিহীন ,
একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা ।
আর-সব কাজ ভুলি আকাশে তরঙ্গ তুলি
সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত ।
যত করে হায় হায় কোনোকালে নাহি পায় ,
তবু শূন্যে তোলে বাহু , ওই তার ব্রত ।
কারে চাহি ব্যোমতলে গ্রহতারা লয়ে চলে ,
অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর ।
সেইমতো সিন্ধুতটে ধূলিমাথা দীর্ঘজটে
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।

একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে ,
‘ সন্ন্যাসীঠাকুর , এ কী , কাঁকালে ও কী ও দেখি ,
সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে । ‘
সন্ন্যাসী চমকি ওঠে শিকল সোনার বটে ,
লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন ।
একি কাণ্ড চমৎকার , তুলে দেখে বার বার ,
আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন ।
কপালে হানিয়া কর বসে পড়ে ভূমি- ‘ পর ,
নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা ;
পাগলের মতো চায় — কোথা গেল , হায় হায় ,
ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা ।
কেবল অভ্যাসমত নুড়ি কুড়াইত কত ,
ঠন্‌ ক ‘ রে ঠেকাইত শিকলের ‘ পর ,
চেয়ে দেখিত না , নুড়ি দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি ,
কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশপাথর ।

তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন ।
আকাশ সোনার বর্ণ সমুদ্র গলিত স্বর্ণ ,
পশ্চিমদিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন ।
সন্ন্যাসী আবার ধীরে পূর্বপথে যায় ফিরে
খুঁজিতে নূতন ক ‘ রে হারানো রতন ।
সে শকতি নাহি আর নুয়ে পড়ে দেহভার
অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন ।
পুরাতন দীর্ঘ পথ পড়ে আছে মৃতবৎ
হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ ।
দিক হতে দিগন্তরে মরুবালি ধূ ধূ করে ,
আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ ।
অর্ধেক জীবন খুঁজি কোন্‌ ক্ষণে চক্ষু বুজি
স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর ,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ আবার করিছে দান
ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর ।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১২৪ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন