শংকর ব্রহ্ম

গল্প - বাঘিনীর সঙ্গে প্রেম

লেখক: শংকর ব্রহ্ম
প্রকাশ - শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ধরণ: ভালোবাসা

বাঘিনীর সঙ্গে প্রেম
শংকর ব্রহ্ম

আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে এটা একটা বাঘিনী ছিল। আমি তার গড়গড় আওয়াজ শুনেছিলাম শুধু।
আমার বাড়ির ভেতরের প্রবেশের পথটি খোলা ছিল, আমি দেখলাম সে সেখান দিয়ে ঢুকেছিল। ঢুকেই সে এদিকে সেদিকে দু’একবার তাকাল। ভাবলো একটু কিছু । তারপর আমার ঘরে ভিতর অন্ধকারে সে এসেছিল, এসে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল, আধো আলোতে দেখে আমি পরে চিনলাম এটা একটা বাঘিনী।
শুয়ে পড়ে সে গভীর এবং স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছিল এবং শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়ল, মনেহল। তার গা থেকে লতা পাতার ভেজা তাজা গন্ধ আসছিল। একটি বন্য প্রাণীর গন্ধ যা আমাকে ভীষণ সম্মোহিত করে দিয়েছে। আমি এটা বলতে পারি যে সে রাতে একটি বাঘিনী আমার বাড়িতে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ল। প্রথমে তার গা ভেজা ছিল, তার ত্বক থেকে আর্দ্রতা ছড়িয়ে পড়েছিল, যা আমার চারপাশে এক শীতলতার সৃষ্টি করেছিল।
আমার কাছে আসার জন্য অবশ্যই তার সাঁতার কাটার প্রয়োজন হয়ে পড়ে ছিল, কারণ কাছেই ছিল বড় একটা নদী, আর তার ওপারে বন।

শরৎকালের মতো শীতল বাতাস সমভূমি অতিক্রম করে এখানে আসছিল। গ্রীষ্মকাল এখনও বর্তমান এবং গরমের ভাবটাও তাজা আছে। বাতাস আসছিল দূরের নদীটা থেকে, এবং আমি ভালভাবে তার জলজ গন্ধ নাকে টের পাচ্ছিলাম।
রাতে আমিও ভাল ঘুমিয়েছি। বাঘিনীও ছিল চুপচাপ এবং মনেহয় ভাল ঘুম হয়েছে তার।
সকালের দিকে, উষ্ণতা ফিরে এসেছিল তাঁর শরীরে। যখন সকালে তার ঘুম ভাঙল, তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে, আমার বাড়ির সামনে বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে
বড় নদীটার দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি তাকে কাছে আসবার জন্য ইশারা করলাম এবং আমি তাকে মাংস খেতে দিলাম। আমি আশা করেছিলাম যে সে হয়তো কাছে এসে আমার সাথে কিছু কথা বলবে, কিন্ত সে ছিল নীরব। তবে সময়ে সময়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল, তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল আমাকে তার কিছুই বলার নেই। অবশেষে, আমি তার সাথে কথা বলার প্রত্যাশা ছেড়ে দিলাম। অন্য কাজে ব্যস্থ হয়ে পড়লাম। সে সেখানেই বসেছিল। তবে আমি প্রায়ই তার সাথে আমার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতাম এবং আমি ভাবতাম য, সে সেগুলো বুঝতে পারছে।
যে রাতে, বাঘিনীটি এসে আবার আমার পাশে ঘুমিয়েছিল। তারপরের দিন সে বাড়ির পাশে আমার আম বাগানে দিন কাটিয়েছি সূর্যের বিপরীতে, ছায়ায় বসে। মাঝে মাঝে আমি ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেতাম, দূরের বনের আর নদীর দিকে তাকিয়ে। আমি তাকে দেখতাম নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সে প্রবাহিত জলের দিকে তাকিয়ে থাকত।

সেদিন আমি তাকে বলতে গেছিলাম,
‘বেশ কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাব, তোমাকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমার না থাকর সময়, তা বেশ কয়েক দিন ধরে চলতে পারে, তুমি বাড়ির ভিতরে বা বাইরে থাকতে চাও? আমি দরজাটি তালাবন্ধ করব কিনা জানতে চাই। উত্তর না দিয়ে বাঘিনীটি শুয়ে পড়ল দ্বারপ্রান্তে, এবং আমি জানতাম যে আমার ঘর বন্ধ করার দরকার নেই, আমি চলে গিয়েছিলাম।

আমি ফিরে এসে দেখি, বাঘটি খোলা চোখে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে সে উঠে বসল। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উদাস ভাবে দূরে তাকাল।
বাড়িটি যেমন ছিল তেমনি আছে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং তার জন্য আমি কিছু মাংস নিয়ে এসেছি, তাকে জানাই। সে তার কোন প্রতি-উত্তর না দিয়ে আবার দরজার পাশেই শুয়ে পড়ে।

তার কিছুদিন পর আমি যখন নদীতে মাছ ধরতে যাই তখন সে প্রায়ই আমার সঙ্গে যেত। নদীর পাশে বসে থাকত। আমি যে মাছটি ধরতাম, তা মনোযোগ দিয়ে দেখতো।
যখন আমি বনের মধ্যে কাঠ কাটতে যেতাম (সেখানে সে ছিল) সে আমার সঙ্গে যেত এবং ফিরে এসে প্রতি রাতে সে আমার পাশে ঘুমাত।
তারপর একদিন সে ভোরের দিকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ধীরে ধীরে এবং নিঃশব্দে।
যাবার আগে সে আমাকে একবার স্পর্শ করল আমাকে জাগাতে, এবং সে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে. আমি বুঝিনি যে সে চলে যাবে, তারপর সে ধীরে ধীরে আমার বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে, নদীর দিকে বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল দেখে, আমি সে দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাঁতার কেটে নদীর ওপারে সে চলে গেল। তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল।
আমি আর বিছানা ছেড়ে উঠিনি। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একটু পরেই সে ফিরে আসবে। কিন্তু আশ্চর্য, সে আর ফিরে এলো না।
আমি ভাবতে পারিনি যে চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। জানতে পারলে, বুঝতে পারলে, হয়তো তাকে যেতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।

আমি এখনও আশা করি যে সে আবার একদিন আমার কাছে ফিরে আসবে।
আমি আজকাল আর নদীতে মাছ ধরতে যাই না। কিংবা যাই না বনে কাঠ কাটতে। আমার যেন এখন আর কোন কাজ নেই। কোন কাজ করতে আমার আর ভালও লাগে না।
আমি এখন নদীর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি, আর ভাবি তার কথা। যেদিন সে প্রথম এসেছিল, মনে পড়ে যায় সে কথা। সে যেন আমার কাছ থেকে সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।

আজকাল আমি ঘুমোতে যাওয়ার আগে, একবার হলেও ভাবি তার কথা, একদিন হয়তো সে ফিরে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়বে। ঘুমের মধ্যে, আমি তার গাঢ় শ্বাস ফেলার শব্দে জেগে উঠে দেখব সে আমার পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আমি আজকাল একা একাই শুয়ে থাকি । ঘুম আর আসে না রাতে, তার কথা ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে যায়। আমি বাইরে বেরিয়ে এসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা কিছু সাতার কেটে আমার দিকে আসছে যেন মনেহয়। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে চরাচর জুড়ে, আমি হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। ইচ্ছে পূরণ হয় না। আমি আবার পরের দিন যাই। আবার পরের দিন …
যাওয়াটা আমার কাছে এখন একটা নেশার মতো হয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ২৮ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন