কবিতার সঙ্গে সহবাস (দ্বিতীয় পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম
[দ্বিতীয় পর্ব]
(তিন).
কবিতা সরাসরি কথা বলে না। কবিতা লেখা হয় সান্ধ্যভাষায়, তাই বহুক্ষেত্রে কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই ধরতে পারেন, বুঝতে পারেন।
সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে, সে’সব কবিতাগুলো দূরহ বলে মনে হয়, তাদের কাছে। কবিতায় দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন সে’সব লেখা, অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে – রূপক, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষণ, নিপুণ শব্দ ব্যাবহারের আশ্চর্য দক্ষতা, সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়, ভাবে ও ভাষায়।
অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না। কিংবা বলা ভাল লেখা যায় না।
কবিতা লেখার পূর্বেই এ’সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে,মনের ভিতরে ভিতরে। এইসব প্রক্রিয়াগুলো, মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করতে পারলে, তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়, অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না। কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস। তিনি মনে করেন, ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায, ররীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ছন্দ প্রয়োগ নিয়ে, ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন একদা আপত্তি তুলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তার তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। কারণ ছন্দ ঠিক রাখতে গেলে, কবিতার ভাব বিভ্রাট ঘটত।
ছান্দসিকরা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ, ছন্দের জন্য কবিতা নয়। ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র, তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা নিজস্ব চুম্বক আকর্ষ আছে, যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত। কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে, কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
‘কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।’
প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে, সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ, কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য, বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত, সে তার ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়, কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়, তাই যদি হতো তবে “সদ্ভাব শতক” শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত, তা কিন্তু পায়নি। কিংবা খনার বচন কবিতা বলে গণ্য হতো। তা হয়নি কখনও।
স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।
সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়। তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ সমাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন, করবেন তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না। কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়, ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য, সৎ কবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল। তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন বাসিন্দা। তাই তাকেও অন্য সকলের মতো হাঁট বাজার করতে হয়। ফলে সমাজের ভাল-মন্দের দায় তার উপরও বর্তায় বইকি। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না বা থাকেন না।
এই জন্যই বোধহয়, দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে ‘সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী’ বলে
অভিহিত করেছেন।
অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই, ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই। অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,
“মূর্খ বড় ,সামাজিক নয়”।
কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার। সে স্বাদ গ্রহণের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহণের, নতুবা তার কাছে, সে’রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।
(চার).
ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
‘কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলেন,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।’
কবিতায় কবি কথা বলেন। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলেন? কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে? তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না। অবশ্য একটা তফাৎ থাকে । পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। পাগলকে তা লিখে রাখতে হয় না। কবিকে তার কথাগুলি লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয় তবে? কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
কিন্তু কেউ শুনবে কেন, তার আবোল তাবোল বলা কথাগুলো, যদি না তাতে পাঠকের মনে রস সঞ্চার হয়? যদি না তার অুনুভূতি তন্ত্রীতে আলোড়ন তোলে?
তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা দাঁড়াচ্ছে, কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও, সে চায় তার কথাগুলি পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে। তাই সে কথাগুলো লিখে রাখে, ছাপতে দেয়, তাই তো?
পাগলের সে সব কোন দায় থাকে না।
তবে কবিকে পাগল না বললেও বাতুল বলা চলে।
কবি অনেক সময় অনেক কথা বানিয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশী করে বলেন। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে হয় উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, রূপক, উৎপ্রেক্ষণ, ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
আগেই বলেছি, কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। সে ভাষা ইঙ্গিতময়।
অবশ্য আনন্দ বর্ধন বলেছেন, ‘যে-বাক্যবদ্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের লভ্য নয়, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই।’
অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, কবিতা কখনও তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না।
কবিতাকে তিনি বিশেষ এক ধরণের ভাষার শিল্প বলে মনে করতেন, তিনিএমনও ভাবতেন যে, কবিতা হচ্ছে এমনই সুকুমার একটি শিল্প, যা তার উপাদান হিসেবে শুধু সুকুমার শব্দই দাবি করে। সমস্ত শব্দই যে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য, এবং যোগ্যজনের হাতে পড়লে, কোনও শব্দকেই যে কবিতার মধ্যে অনধিকার-প্রবেশকারীর মতো অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, এই উদার ধারণা তাদের কাছে প্রশ্রয় পায়নি।
রবীন্দ্রনাথও এই ভাবনার অংশীদার ছিলেন প্রথমদিকে। তিনি তাঁর কবিতায় কোথাও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেননি, কিংবা নামোল্লেখ করেননি। কিন্তু পরবর্তী কালে,তার কবিতায় নিত্য ব্যবহার্য হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ আর ‘ঝুনা নারিকেল’ পর্যন্ত এমন-সমস্ত শব্দের উল্লেখ ঘটেছে, তার কবিতায়। যদিও তিনি কবিতায় আটপৌরে শব্দ কবিতায় ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না।
পরবর্তী কালে ওয়ার্ডসওয়র্থ এসে বললেন,
যে, শুধু সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা কিনা মানুষের নিত্যব্যবহার্য মুখের ভাষা। শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন, বাকছন্দ। যাতে আজকাল অধিকাংশ কবিতা লেখা হচ্ছে।
কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে, সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা, প্রিয় কবির প্রভাব, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার, যেটা কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
কেউ কেউ, মালার্মের মতো মনে করেন, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব অনুভূতির উন্মেষ, সেই কবিতা পাঠকের বোঝার ব্যাপারে, কবির কোন দায় নেই। এ’কথা শুনতে যতোই কাব্যিক লাগুক, পুরোপুরি মানতে দ্বিধা হয়।
পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে, পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক, তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া, তাকে আর বেশী কিছু বলা চলে না। পাগলও নিজের সঙ্গে কথা বলে, কারও কোন দায় থাকে কি, সেসব কথা শোনার?
কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে,অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।
উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভালো। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে।
এই ” বিশেষ জ্ঞানে”র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
রবীন্দ্রনাথের এ’মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
” মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন,
ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক ।
অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্র ছিল। তার ভাষায়, “আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।
কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
“কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।”
কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়, কখনও চিত্রকল্পের, কখনও রূপকের, কখনও উৎপ্রেক্ষণের, কখনও ছন্দ মাধুর্যের, কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের আশ্চর্য দক্ষতার। সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত।
এ’সব অনুভবের ব্যাপার, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে, ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকেই যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয় তো!
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,
” শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই(শব্দ) সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।”
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, ‘ শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।’ বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে , তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
বস্তুত, শব্দ বাছাইয়ের উপর নির্ভর করে, এর পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কোন কোন কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন। অবশ্য সকলে নয়। সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজে হযে ওঠে না, বরং তা খুবই কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ” কঠিন সাধনার”।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার মনেহয়।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন