মগজ ধোলাই
শংকর ব্রহ্ম
(১).
কবির অবস্থান থাকে এক অবমিশ্র ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার চূড়ান্ত অবসাদ অবস্থায়, মৃত্যুর নান্দনিকতায় সফেদ দেওয়ালে নোংরা ছোপলাগা পলেস্তার খসা ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে,মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে গুমরে কেঁদে মরে, অনিশ্চিত এক চৈতন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়,যেখানে আর কোন রকম আশ্রয় মেলে না নিশ্চিত ভাবেই।
এই ভাবনা যে কবিকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সঠিক জানা না থাকা,ক্রন্দন চুঁয়িয়ে এসে জমা হয় মৃত্যুর মতো সুপ্ত এক চূড়ান্ত পরিস্থিতির মধ্যে।
নসননননসন সাহিত্য-শিল্প যদি বিপ্লবকে বন্ধন মুক্ত করে, তরান্বিত করে, তাহলে দারিদ্রের রূপরেখা প্রাচীরে মাথা ঠোকে, আর তার কান্না বাস্তবতার প্রতিধ্বনি হয়ে ফুটে থাকে মাত্র,তার বেশী কিছু নয়, এ’কথা যিনি বুঝতে পারেন না, তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে লেখেন,তার চিন্তা খানিকটা অতীতের দিকে ঝুঁকে থাকলেও অভিমুখ থাকে ভবিষ্যতের দিকে। ভাষা যদিও অবাধ্য তার কাছে, সে’কথা সঠিক জানা থাকায়, ক্রমশঃ ক্রন্দন এসে চুঁয়িয়ে জমা হয় অসহায় ভাবে নির্মম মৃত্যুর এক চূড়ান্ত পরিস্থির মধ্যে।
সেখানে তার অবস্থান থাকে এক অবমিশ্র অবস্থায়, মৃত্যুর নান্দনিকতায় তাকে নিয়ে যায় , যেখানে নিশ্চিত ভাবেই তার আর কোন আশ্রয় মেলে না।
(২).
সসসসসসস অনেক সময় আমাদের স্বভাব হয়ে ওঠে আমাদের প্রিয়তম শত্রু। অভ্যাস ক্রমশই আমাদের আধুনিক অনুশাসনে পরিণত হয়ে উঠলে, প্রাচীন কুসংস্কারের মতো সেটাও কিছু কম বাঁধার সৃষ্টি করে না।
যেখানে এর জন্ম, সেখানেই সে ডালপালা বিস্তার করে। সেটি খুবই বেদনার করুণ অঞ্চল , যা মানুষের দুর্দশার প্রধান কারণ হয়ে ওঠতে পারে সহজে এবং ভ্রান্তি ডেকে আনে মনের ভিতর।
আজকাল অনেকই সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে অনুগত হয়ে পড়েন স্বার্থের কাছে, প্রভাবশালীর প্রতিপত্তির কাছে, যদিও তা তার বিপত্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে, তবু সে মোহের বশে আর তা থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। তখন চাঁদের আলোয় ঘাঁয়ের উপর মলম লাগায়,আত্মতৃপ্তির উপায় হিসাবে।
জীবনের একটা মৌলিক প্রবাহ থাকে, যার মধ্যে প্রতিদিনের আশা আকাঙ্ক্ষা আবচ্ছায়া ফেলে, তাই যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, আমাদের অতৃপ্তির চোঁয়া ঢেকুর রোধে কোন হজমোলাই আর তেমন সুফল প্রদান করতে পারে না, বরং দিন দিন উদ্গীরণের পরিমাণ উত্তরোত্তর এতো বৃদ্ধি পায় যে, সে এক সঙ্কটময় সময় উপস্থিত করে।
এর থেকে সহজে বের হবার কোন সুনির্দিষ্ট উপায় আজ পর্যন্ত বের হয়নি, তবে মানুষ আশাবাদী, সে হাল ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে সে বসে থাকার পাত্র নয়, সুমেরু থেকে কুমেরু চষে ফেলছে সে। তা ফেলুক, আপত্তির কোন কারণ নেই, তবে মাঝে মাঝে মনেহয়, উপায় কি সত্যিই কোনদিন বের হবে? নাকি শুধু কলুর বলদ হয়ে ঘোরাই শেষপর্যন্ত সারকথা হবে?
(
পেন্ডুলাম – (৩).
আমাদের করোটির ভিতরে পাশাপাশি ভর্তি রয়েছে, বিশ্বাসের গরম বাষ্প এবং যুক্তির বরফখন্ড,কিন্তু তাদের মধ্যে সাধারণতঃ পরস্পরের উপর কোন প্রভাব
নেই। বাষ্প হয় না ঘনীভূত কিংবা বরফ যায় না গলে। মানুষের মন পরস্পর বিরোধী স্তরে বিচ্ছিন্ন,মূলতঃ চিত্তভ্রষ্ট।
আদিম মানুষ জানে যে তার দেবতা হচ্ছে
একটা পাথরের টুকরো (নারায়ণ শিলা), অথচ সে বিশ্বাস করে তার দুর্দশা দূর করার ক্ষমতা সে পাথরের আছে। এই দ্বৈততা বিশেষ স্নায়ুপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত। অযৌক্তির বিশ্বাসের মূল হচ্ছে ভাবাবেগ।
” অবিশ্বাসের যুগগুলি হচ্ছে নতুন কুসংস্কারের দোলনা।” – আমিয়েল।
লেভি ব্রহল প্রমাণ করেছেন,আদিম মানুষের মানসিকতা হচ্ছে যুক্তিপূর্ব।
ফ্রয়েড, চিন্তার আধুনিক মূলসূত্রগুলো দেখালেন এবং অনুস্মরণ করলেন তাদের টোটেম ও ট্যাবু।
ইয়াং দেখালেন যে কতগুলি অপ্রচলিত ও মূল আদর্শের প্রতিরূপ হচ্ছে আমাদের জাতীয় সমষ্টিগত সম্পত্তি। বিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেটা মনের মধ্যে কার্যকলাপের অযৌক্তিকতা দেখাবার মতো যথেষ্ট যুক্তিবাদী।
যে বিজ্ঞান এই সব প্রসারের দ্বারা সবচেয়ে কম প্রভাবিত হয়েছে,তা হলো রাজনীতি।সমাজতন্ত্রবাদের ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে,মানুষের মনের অযৌক্তিক অংশকে তাদের অবহেলা।
পদার্থবিদেরা যেভাবে একটি আলোকরশ্মিকে ভাগ করেন, সেইভাবে যদি সামাজিক আচরণকে বিশ্লেষণ করার যন্ত্র থাকত,তবে সেই যন্ত্রের মধ্যে চোখ দিয়ে আমরা মানবিক জীবন-দর্শনের একটা ইন্দ্রধনু সুলভ বর্ণ বৈচিত্র দেখতে পেতাম।আমাদের চারপাশে দুর্বোধ্য যত গন্ডগোল তা’হলে তা আমাদের কাছে প্রঞ্জল,পরিচ্ছন্ন আর বোধগম্য হয়ে উঠত।
এই বর্ণ বিস্তারের একদিকে আমরা দেখতে পেতাম শাসনকর্তাকে, যে বাহির থেকে পরিবর্তনে বিশ্বাসী। যিনি মনে করেন, ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে কোষ্টবদ্ধতা মানব জীবনের যে কোন মন্দ দিক,পরিবর্তন করা সম্ভব বল প্রয়োগের মাধ্যমে। তিনি মনে করেন এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ফন্দি-ফিকির, জুয়াচুরি, বিষ বা বল প্রয়োগ যা খুশি করা যেতে পারে। বর্ণচ্ছটার অপর প্রান্তে যোগীর অবস্থান। তিনি মনে করেন, আমাদের লক্ষ্য অজ্ঞেয়, পথ বা উপায়টাই মূল্যবান। তিনি হিংসাকে সব সময়ই পরিত্যাগ করে চলতে চান। তার মতে মনই ধ্রুবসত্য। তিনি বিশ্বাস করেন, বাইরের কোন সজ্জার দ্বারা কোন উন্নতি করা সম্ভব নয়, কল্যাণের আবির্ভাব হবে অন্তর্জগতের চেষ্টার দ্বারা। তিনি মনে করেন,প্রত্যেক ব্যক্তিই নিঃসঙ্গ, একা।
কিন্তু এই এক ও অদ্বিতীয়ের সঙ্গে তার একটা নাড়ীর যোগ আছে।
এই দুই চরম প্রান্তের মধ্যবর্তী অংশে সাধারণ মানুষের অবস্থান। আর তাদের মূল সমস্য হল যোগী আর শাসনকর্তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আর বাহ্যিক পরিবর্তন এই দুই ধারার আবর্তনে সে দোদুল্যমান।
বলা খুব সহজ যে এখন প্রয়োজন সমন্বয়ের, কিন্তু বলা যতটা সহজ করা মোটেই ততটা সহজ নয় বলেই, তা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বস্তুতঃ এই দুইটি জিনিষের মিলন অসম্ভব। কারণ, একদিকের লক্ষ্য মানুষের সঙ্গে সমাজের
সম্পর্ক, আর অন্যদিকের লক্ষ্য মানুষের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সম্পর্ক। দুটিকে মেলানোর চেষ্টা অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সমরতিসম্পন্ন কোন পুরুষকে নারী আকর্ষণে কিঞ্চিৎ উৎসুক করে তোলার জন্য আমন্ত্রণ করার মতো ব্যাপার। যে আমন্ত্রণ বাস্তবিক নিরর্থক হয়ে যায় শেষপর্যন্ত।
এখন উপায়?
উপায় আর কি, এই দোলাচলের মধ্যে থেকে পেন্ডুলামের মতো দুলে চলা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
মগজ ধোলাই ••• (৪).
সহমত হয়েই আক্রমণ কর শত্রুকে
তারপর পরাজিত ব্যক্তিকে
উঠে দাঁড়াতে সহায়তা কর
এবং তাকে অবাক করে
বুকে টেনে নাও।
সানন্দে দেখ কি কঠিন আঘাতে
বিদীর্ণ করেছ তাকে।
পরাজিত ব্যক্তিও একজন মানুষ
এ কথা ভুলে যেয়ো না কখনও।
কেউ মানতে না চাইলে
তার কথা মেনে নিয়ে
ওই দশা কর তারও
তারপর হাত বাড়িয়ে দাও অক্লেশে
তার দিকে বন্ধুত্বের।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন