স্বপ্নময়ের স্বপ্ন
শংকর ব্রহ্ম
(এক).
শ্যামলের সঙ্গে বাজারে দেখা স্বপ্নময়ের। শ্যামল কবিতা লেখে। পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। তার জন্য তার মনে একটা চাপা শ্লাঘার ভাব কাজ করে। স্বপ্নময় গল্প লেখে। নতুন ধারার গল্প। দু’একটা পত্রিকায় সে লেখা পাঠিয়েছিল। ছাপা হয়নি। ফলে সে কিছুটা মনমরা ও উদাসীন হয়ে পড়েছে। লেখালেখির ব্যাপারে হতাশা তাকে উদ্যমহীন করে তুলেছে।
দু’জনেই প্রায় সমবয়সী। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের কাছাকাছি হবে দু’জনেরই। একটা চায়ের দোকানে এসে বসলো ওরা। শ্যামল চায়ের দোকানদারকে, দু’টো লিকার চা দিতে বলে। তারপর বুক পকেট থেকে একটা সিগারেট প্যাকেট বের করে, সস্তার একটা চার্মিনার সিগারেট ধরায় নিজে, প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট বের করে এগিয়ে দেয় স্বপ্নময়ের দিকে।
সিগারেট ধরিয়ে সে নিজে মুখ ভর্তি ধোঁয়া টেনে নেয় ভিতরে। তারপর ধীরে ধীরে নাক মুখ দিয়ে সেই ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করে। ধোঁয়া ছাড়া শেষ হলে, তারপর স্বপ্নময়কে বলে, তোমার লেখালেখি কেমন চলছে বলো?
– আর লেখা ! স্বপ্নময়ের সুরে হতাশা ঝরে পড়ে।
– মানে ? শ্যামল কৌতূহলী হয়।
– লিখে আর কী হবে, যদি কোথায়ও ছাপা না হয় সেসব?
– কেন? তুমি লেখা পাঠিয়ে ছিলে কোথায়ও?
– হ্যাঁ, প্রভাত সংবাদ, দৈনিক সমাচার প্রভৃতি কাগজে পাঠিয়েছিলাম, ছাপেনি।
– ওদের দলবাজীর ব্যাপার আছে। নিজেদের চেনাজানা লোক ছাড়া ওরা অন্যদের লেখা ছাপে না।
– তাই নাকি?
– কেন তুমি জান না?
– না, আমি এসব জানব কী করে?
– সত্যিই তাে, জানবে কী করে। তা তুমি ‘যুগবাংলা’- য় লেখা পাঠিয়ে দেখতে পারো।
– ওরাও যদি না ছাপে?
– মনে হয় ছাপবে।
– কী করে বুঝলে ?
– অনেকের লেখাই ওরা ছাপেন দেখেছি। গত
সংখ্যায় আমার একটি কবিতা ছেপেছেন।
– তাই? তবে আমার লেখা যদি না ছাপে?
– তাহলে আর কী হবে? বরং তুমি নিজেই একটা পত্রিকা বের করাে। অন্যদের সঙ্গে নিজের লেখাও ছাপতে পারবে সেখানে।
শ্যামলের কথাটা, স্বপ্নময়ের মনে ধরে।
সে স্থির করে, নিজে একটা পত্রিকা বের করবে, সামনের বইমেলায়।
তার ধারণা, তার লেখা বোঝবার মতাে সম্পাদক খুব কমই আছেন, সে ছিল কল্লোল, কালি কলমের যুগে। বর্তমান সময়ে, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বস্তাপচা গল্প ছাপতেই আগ্রহ বেশি বর্তমান কালের সম্পাদকদের। যত সব, থোর বড়ি খাড়া। নতুনদের পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক আধুনিক ভাবধারার লেখা ছাপতে ভরসা পায় না তারা। তাদেরও দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। তাদের লক্ষ্য বিপণন, নতুন মনস্কতার পাঠক তৈরি করা তাদের কাজ নয়। নিজের একটা পত্রিকা থাকলে, সেখানে এই সব লেখাগুলি অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, সুইডেন , স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এই সব দেশের লেখার কোন খোঁজ খবরই রাখেন না, এইসব সম্পাদকেরা। ব্যবসা হবে, এমন সব চটকদারি লেখা, গতানুগতিক ভাবনার লেখা গল্প ছাপার দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।
স্বপ্নময় বলল, ভাবছি একটা পত্রিকা বের করব। ভারিক্কি চালে শ্যামল বলল, হ্যাঁ তাই করো। প্রয়ােজন হলে আমাকে বােলাে, আমি তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব। দোকানিকে চায়েের দাম মিটিয়ে দিয়ে , ওরা যে যার কাজে বেরিয়ে গেল।
(দুই).
এরপর বছর দু’এক কেটে গেছে। পত্রিকা অবশ্য আর বের করা হয়নি স্বপ্নময়ের। এরমধ্যে স্বপ্নময়ের বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
ইদানীং তার একটি গল্পের বই বেরিয়েছে বইমেলায়। তার নিজের খরচে। বইটির ছাপা বাঁধাই মামুলি ধরণের। প্রচ্ছদে বিখন্ডিত একটি পাথুরে দেবমূর্তি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি টুকরো টুকরাে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বইটির নাম – ‘ঈশ্বরের ঈশ্বরপ্রাপ্তি’।
– লেখাগুলি কেমন ?
– তা না পড়লে, বাঝানাে যাবে না।
স্বপ্নময় আর্থিক আনটনের মধ্যে বহু কষ্টে , গল্পের বইটি একশাে কপি বই ছাপিয়েছে। কিছু কিছু নামী দামী পত্র পত্রিকায় সমালােচনার জন্যে পাঠিয়েছে। কিছু বই জানা, চেনা পরিচিতিদের মধ্যে বিনা পয়সায় বিলি করেছে। তার ধারণা, বইটি পড়ে মুদ্ধ হয়ে, তারা অনেকেই তাকে উৎসাহিত করে, উদ্দীপনামূলক চিঠি পাঠাবে। বইটি প্রকাশ হবার পর থেকেই, স্বপ্নময়ের ভিতর, প্রত্যাশার পারদ ক্রমশঃ চড়তে শুরু করেছে।
তার ধারণা বইটি পড়ে সম্পাদক ও সমালােচকরা, তার লেখা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। আধুনিক ছোটগল্প সম্পর্কে তাদের ধারণা বদলাবে। অনেকেই প্রশংসা করবেন, তার এই প্রচেষ্টার। আর তখন অন্য সব সম্পাদকদের টনক নড়বে। তার লেখা তখন তারা ছাপবেন।
পাঁচ কপি বই, যাদবপুর কফি হাউসের নীচে, যে ম্যাগাজিন স্টলটি আছে, তাতে দিয়ে এসেছে সে, বিক্রি করার জন্য। আজ সন্ধ্যায় একবার সেখানে যেতে হবে খোঁজ নিতে, বইটির বিক্রি কেমন হচ্ছে তা জানার জন্য।
(তিন).
বইয়ের স্টল থেকে হতাশ মনে বেরিয়ে এলো স্বপ্নময়। এক কপি বইও বিক্রি হয়নি তার। দোকানদার অবশ্য তার বইটি স্টলে ভালভাবে ডিসপ্লে করেছেন , যাতে সবার নজরে পড়ে। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই, চোখের উপর জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে , ‘ঈশ্বরের ঈশ্বরপ্রাপ্তি’। নীচে লেখকের নাম স্বপ্নময় ব্রহ্ম।
স্টল থেকে বেরিয়ে এসে সে ভাবল, বাসে করে বাড়ি ফিরতে ছ’টাকা লাগবে। তার চেয়ে হেঁটে ফিরল, ওই টাকায়, এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে। হেঁটেই ফিরবে মনস্থির করে ফেলল সে, বাড়ি ফেরার জন্য হাঁটতে শুরু করার আগে সে একটি চায়ের দোকানের খোঁজে, এদিক সেদিক তাকাতে লাগল।
আচমকা তার সামনে, যেন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে, হাজির হলেন লোকটি এসে। হঠাৎ তার মনেহল, যেন তার বই থেকে নেমে এসেছেন ঈশ্বর। কিন্তু না, ঈশ্বরের স্বরূপ দেখিয়ে, কোনও বর প্রার্থনা করতে বললেন না তিনি তাঁর কাছে। বরং তাকে সাধারণ মানুষের মতো মনুষ্য কন্ঠে বললেন, আশুতােষ পল্পী যাব কীভাবে বলতে পারেন?
– অটোতেও যেতে পারেন। আবার লোককে জিজ্ঞাসা করে পায়ে হেঁটেও চলে যেতে পারেন।
স্বপ্নময়ের বয়স এখন আঠাশ বছর। কিন্তু দেখে মনে হতে পারে চল্লিশ। এমন চালসে চেহারা। প্রতিদিন পেট ভরে খাবার জোটে না, প্রকট দারিদ্রের ছাপ চোখে মুখে। মাথায় কাঁচা-পাকা, এক মাথা ঝাকড়া চুল, ঘাড় পর্যন্ত লতানাে। মুখে এক সপ্তাহের না কামানাে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কাঁচা-পাকা গোঁফ। চাখ দুটি কোটরে ঢোকা , তবু তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ধারালো। গায়ে সস্তার ছিটের প্রিন্টেড জামা, রংচটা ঢলঢলে প্যান্ট পরনে।
স্বপ্নময় ভাল করে আগন্তুক লােকটিকে দেখল। তাঁর বয়স বোঝা বেশ কঠিন। শরীরের চেকনাই ভাব দেখলেই, বােঝা যায় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন, কোনও অর্থাভাব নেই। চোখ দুটি পরিতৃপ্তিতে ঢুলু ঢুলু। মুখে মিষ্টি হাসি, দৃষ্টিতে শিশু সুলভ সরলতা। লােকটিকে স্বপ্নময়ের ভালাে লেগে গেল।
মানুষটি বললেন, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, একটু ভেজাতে পারলে ভালো হতো, অনেকটা পথ আসতে হয়েছে তো।
স্বপ্নময় বলল, এখানে জলটল পাবেন না ইচ্ছে হলে চা বা কফি খেতে পারেন।
তবে চলুন না, একটু কফি খাওয়া যাক। আপনার তাড়া নেই তাে কোনও?
স্বপ্নময় আজ আর টিউশনিতে যাবে না কোন, বলে এসেছে। অন্যদিন সকাল বিকালে দু’জন করে ছাত্রছাত্রী পড়াতে হয়। তাতেই তাদের সংসার চলে। চলে আর কোথায়? স্বপ্নময় ভাবে।
বাবার মৃত্যুর পর, মা সামান্য কিছু পেনশন পায়, তাতেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে কোন রকমে। সংসারে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই।
দিদি ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে দূরে, আসামে। বাবা বেঁচে থাকতেই তার বিয়ে দিয়ে গেছেন। বাবা চলে যাওয়ার পর মা যেন কেমন হয়ে গেছেন। বড় একলা হয়ে গেছেন। খুব যেন ভেঙে পড়েছেন, বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকেন। কথা খুব কম বলেন, প্রায় না বলারই মতোন। তার এখন বেশিরভাগ সময়টাই কাটে ঠাকুর দেবতা নিয়ে। মা কৃষ্ণভক্ত। এখন কৃষ্ণই তার ধ্যান জ্ঞান।
স্বপ্নময় গল্প লেখে, মা তা জানেন। মাকে প্রথম প্রথম সে তার লেখা গল্পগুলি পড়ে শোনাতো। মা সব শুনে, শেষে বলতেন, কী সব ছাই-ভস্ম লিখিস। তার চেয়ে তুই ঠাকুরের কথা লেখ। কত লীলা তার। তাকে নিয়ে তুই লিখতে পারিস না? স্বপ্নময়, এ সব কথার কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন বােধ করেনি কোনদিন।
(চার).
– তবে চলুন, এক কাপ করে কফি খাওয়া যাক।
লোকটি কথাটা বলে হাসি মুখে তার দিকে তাকালেন।
– চলুন তাহলে, বলেই স্বপ্নময়ের মনে একটা সন্দেহের ভাব উঁকি দিলো। আগন্তুক ব্যক্তি যদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কফি খেতে চায় তা’হলে? দেখাই যাক না। এই ভেবে সে মনস্থির করে ফেলে, কফি হাউজে যাবে লোকটিকে নিয়ে। যাদবপুর কফি হাউজে এসে ঢোকে ওরা দু’জনে। খুব একটা ভিড় নেই সেখানে এখন। একটা ফাঁকা টেবিল দেখে, ওরা বসে।
লোকটি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে, সবকিছু দেখছিলেন। কফি হাউজের একজন বেয়ারা কাছে আসতেই , স্বপ্নময় কায়দা করে বলে লোকটিকে, কী নেবেন বলুন ওকে।
লোকটি বেয়ারাটির দিকে তাকিয়ে, তাকে দু’কাপ কফি দিতে বলেন।
একটু পরে স্বপ্নময় কৌতূহল দমন করতে না পেরে তাকে বলেন, কি করেন আপনি?
– কিছুই না।
– তবে চলে কি করে আপনার?
– এই চলে যায় কোন মতে আর কী।
স্বপ্নময় ভাবল, লোকটি বেশ ঘোরাল, ধূর্ত প্রকৃতির। কিছুই খুলে বলতে চায় না নিজের সম্পর্কে। হঠাৎ তার মনে একটা সন্দেহ ঝিলিক মেরে ওঠে, লোকটি কোন সন্ত্রাসবাদী দলের নয় তো আবার। আজকাল খবরের কাগজে প্রায়ই এইরকম সংবাদ থাকে । সাধারণ মানুষের মধ্যে সাধারণ মানুষ হয়ে সন্ত্রাসবাদীরা মিলেমিশে থাকে।
– আপনি কি করেন?
লোকটির প্রশ্নে স্বপ্নময়ের সম্বিত ফেরে।
সে উত্তর দেয়, পেটের তাগিদ মেটাবার জন্য টিউশনি করি কয়েকটা, আর মনের তাগিদ মেটাবার জন্য গল্প লিখি।
– তাই নাকি? কি ধরণের গল্প লেখেন?
– নতুন ধরণের আধুনিক গল্প।
– সেটা আবার কী রকমের?
– এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক গল্প আর কী। আপনি পড়েন গল্প?
– হ্যাঁ। গল্প কে না পছন্দ করে?
– কি বই পড়েছেন?
– রামায়ণ মহাভারত
– ধুর ! সে’রকম গল্প নয়।
– তবে কি রকম গল্প?
– আধুনিক ধরনের গল্প। যেমন, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র – এঁদের কোন লেখা পড়েছেন?
ঈশ্বর মাথা নেড়ে বললেন, না তাে।
– তাহলে আর কী পড়লেন?
নিজের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে, একটি বই বের করে, টেবিলের উপর রাখল স্বপ্নময়। বলল, নতুন বেরিয়েছে এবার বই-মেলায়, দেখুন। নিজের লেখা একখানা বই এগিয়ে দিল তার দিকে।
বইটির নাম আর প্রচ্ছদপট দেখেই যেন মানুষটি কেঁপে উঠলেন ভিতরে ভিতরে। দু-জনেরই কফি শেষ হয়ে গেছে কখন, কথায় কথায় ওরা কেউই খেয়াল রাখেনি সেটা।
– আর এক কাপ করে কফি হোক, আপত্তি নেই তো আপনার? বলে মানুষটা তার মুখের দিকে তাকালেন।
স্বপ্নময়ের কুটিল মন ভাবল, আমাকে আবার কফির দাম দিতে হবে না তো?
স্বপ্নময়ের বইটা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে মানুষটি তাকে বললেন, কি ভাবছেন? স্বপ্নময় তার ভাবনার কথা তৎক্ষণাৎ মনে চাপা দিয়ে রেখে বলল, ভাবছি বইটা কেমন লাগবে আপনার? তারপর সে বলল – তা আপনি বলছেন যখন, বলুন তাহলে।
শুনে মানুষটি হাসলেন।
– হাসলেন যে? স্বপ্নময় জানতে চাইল তার কাছে।
তিনি বললেন, এমনিই।
কফি শেষ করে মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন। হাতে তার স্বপ্নময়ের বইটি। কাউন্টারে এসে কফির দাম মেটাতে গিয়ে, তিনি পাঁচশো টাকার একটি নোট বের করে দিলেন। এবার স্বপ্নময়ের চমকানোর পালা। কাউন্টারের লােকটি চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আগে বলবেন তাে পাঁচশাের নােট। তারপর নোটটি উলটে পালটে কয়েকবার ভালাে করে যাচাই করে দেখলেন। তারপর ক্যাশ বাক্সে রাখলেন। চার কাপ কফির দাম একশো টাকা কেটে নিয়ে, বাকি টাকাটা ফেরত দিলেন তাকে।
কফি-হাউজ থেকে বেরিয়ে এসে, লোকটি স্বপ্নময়কে বললেন, বইটির দক্ষিণা কত ?
স্বপ্নময় নীচুস্বরে বলল, একশো টাকা মাত্র।
লোকটি তার হাতে একখানা একশো টাকার নােট দিয়ে বললেন, রাখুন। স্বপ্নময় এতটা আশা করেনি অবশ্য। কৃতজ্ঞতায় তার মন নুয়ে পড়ল, মনে মনে খুব খুশি হলো সে। স্বপ্নময় তার কাছে জানতে চাইল, আপনি আশুতােষ পল্লী কোথায় যাবেন?
– রথবাড়ি।
স্বপ্নময় ভাবল, আমরাও তো ওই বাড়িতেই ভাড়া থাকি। কিন্ত সে তা প্রকাশ করতে চাইল না লোকটির কাছে। ভাবল, লোকটি যদি আবার ছদ্মবেশী কোনও সন্ত্রাসবাদী হয়, তাহলে? নতৃুবা, যেভাবে অনায়াসে, খােলাম কুচির মতো, পাচশো টাকার নোট বের করে দেয় অবহেলায়, সে হতেই পারে সন্ত্রাসবাদী ! বইয়ের দাম একশাে টাকা দিতে কোনও দ্বিধা বা কার্পন্য বোধ করে না। তাকে বিশ্বাস নেই কোনও।
মানুষটি বললেন, ওখানে আমার একভক্ত থাকে। তার বাড়ি যাব। শুনে স্বপ্নময়, ফিক করে হেসে ফেলল। তিনি তা দেখে বললেন, হাসছেন যে বড়?
– আপনি কি মশাই গুরুঠাকুর নাকি?
লোকটি হাসলেন অমায়িকভাবে, শিশুর মতাে।
– তা বলতে পারেন একরকম। কথা বলতে বলতে বাস রাস্তা এসে গেল।
লোকটি বললেন, চলুন বাসে উঠি।
স্বপ্নময় বলল, বাসে যা ভিড় এখন। আপনার হাঁটতে কোনও অসুবিধা নেই তো? লোকটা সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে, তার সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন। আপনার নামটি জানতে পারি? হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্নটা করেই, স্বপ্নময় কৌতৃহলী চোখে তার দিকে তাকালো।
আমার তো শতনাম, কোনটা বলি? লোকটি মনে মনে ভাবলেন। শুনতে পাননি ভেবে, স্বপ্নময় আবার বলল, আপনার নামটা জানতে পারি?
– হ্যা, রাধামোহন।
– রাধামােহন ! পদবি কি?
– রাধামােহন গুপ্ত।
অষ্টাদশ শতকের পুরােনাে নাম, স্বপ্নময়ের মনেহল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা রামগড় বাস স্টপে এসে পৌঁছে গেল। স্বপ্নময় তাকে বাঁ দিকের গলিটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপনি এখান থেকে সােজা এগিয়ে যান। হেঁটে কিংবা রিক্সায় যেতে পারেন।
রথবাড়ি বললে, যে কেউ আপনাকে দেখিয়ে দেবে। আমি এখান থেকে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরব।
লোকটি ঘাড় কাত করে বললেন, আচ্ছা, আবার দেখা হবে তা’হলে।
কথাটা শুনে স্বপ্নময় ভাবল, লোকটা খ্যাপা বা পাগল নয় তো। নতুবা আবার দেখা হবে, বললেন কেন? যাক গে, এসব ভাবনা চুলোয় যাক এখন।
লােকটার সঙ্গে, আগে থেকে, কোনও চেনা নেই, জানা নেই, একেবারে অচেনা মানুষ। সে তার এক কপি বই তো কিনেছে। এটাই আজ বড় প্রাপ্তি স্বপ্নময়ের কাছে। সে হাত দিয়ে পকেট থেকে নোটটা বের করে, চোখের সামনে মেলে ধরে দেখল, জালি নয় একেবারে আসল একশো টাকার নোট।
রামগড় মোড়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে, একটু রাত করে বাড়ি ফিরল স্বপ্নময়। শুনতে পেল, মা যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন। মা তাে এতটা রাত পর্যন্ত জাগেন না, সে ভাবল। বেশি রাত হলে, স্বপ্নময়ের জন্য খাবার ঢেকে রেখে দিয়ে , নিজে খেয়ে, মা শুয়ে পড়েন। তাহলে, আজ এমন কী ঘটেছে যে মা এখনও জেগে আছেন? মনে মনে ভাবল সে। ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, এই দ্যাখ কে এসেছেন।
ঘরে ঢুকেই, সেই লোকটিকে দেখতে পেয়ে আচমকা, চমকে গিয়ে মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে এল, আপনি এখানে?
লােকটির চোখে তখন রহস্যময় হাসির ঝিলিক।
স্বপ্নময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এ বাড়ির ছেলে? তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সন্তান, রাধা?
– হ্যাঁ প্রভু। তারপর মা স্বপ্নময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের কুলগুরু রাধামোহনানন্দ বাবাজী। লোকটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল মা। স্বপ্নময় দেখে বিস্মিত হল, লোকটি ক্রমশঃ ছোট হতে হতে ঠাকুরের সিংহাসনের কৃষ্ণ ঠাকুরে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন।
(পাঁচ).
– কিরে এখনও ঘুমােচ্ছিস? সন্ধে হয়ে গেল যে, উঠবি না?
মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল স্বপ্নময়ের।
– সে দেখল, মায়ের হাতে ধূপকাঠি।
সন্ধ্যারতি সেরে, মা সারা ঘরে ধূপকাঠি ঘুরিয়ে নিয়ে, আবার ঠাকুরের কাছে গিয়ে বসলেন। তা’হলে এতক্ষণ ধরে সে স্বপ্ন দেখছিল? ভাবল মনে মনে সে। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো স্বপ্নময়। মনে পড়ল, আজ একবার যাদবপুর কফিহাউজে, তার ‘ঈশ্বরের ঈশ্বরপ্রাপ্তি’ বইটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে, যেতে হবে তাকে।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন