শংকর ব্রহ্ম

গল্প - স্বপ্নে ইচ্ছে-পূরণ

লেখক: শংকর ব্রহ্ম
প্রকাশ - বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ধরণ: অন্যান

স্বপ্নে ইচ্ছে-পূরণ
শংকর ব্রহ্ম

উমার বয়স চোদ্দ বছর। যখন যেখানেই থাকুক ঘাড় কাৎ করে আয়নার দিকে তাকিয়ে একবার নিজেকে দেখে নেওয়া তার অভ্যাস। কেমন দেখায় তাকে দেখতে? সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তার। তার মা এসব কিছু লক্ষ্য করে শান্ত স্বরে বলে, নিজের দিকে তাকানো বন্ধ কর এবার। তুমি কি মনে কর, তুমি খুব সুন্দরী? শুনে উমার ভ্রু কুঁচকে উঠে।
উমা জানে যে সে সুন্দরী। তার মাও খুব সুন্দরী ছিল, অ্যালবামের পুরানো ছবিগুলি দেখলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু এখন তার সে সৌন্দর্য ঝরে গেছে এবং এখন সে বিবর্ণ শুকনো পাতার মতোই মলিন। তাই সে বোধহয়, কারণে-অকারণে সর্বদাই উমার পিছনে লেগে থাকে, উমার তাই মনেহয়।

মা বলে, তুমি তো তোমার দিদির মতো তোমার নিজের রুমটা গুছিয়ে রাখতে পার। তা না, রুমটা নরক-গুলজার করে রাখ সব সময়। মা সমানে গজগজ করতে থাকে। উমা তার কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ, উমা জানে, একটা কিছু নিয়ে গজগজ করা মার স্বভাব।

তার দিদি শ্যামা,তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। এখন তার বয়স, উনিশ । সে শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজে পড়ে। আর উমা পড়ে বেলতলা গার্লস হাইস্কুলে।
মা তো শ্যামার প্রশংসা করতেই সব সময় ব্যস্ত, মাসিমণিরাও বাড়িতে এলে বলত, শ্যামা এটা করেছে, শ্যামা ওটা করেছে, শ্যামা সেটা করেছে,শ্যামা টাকা জমিয়েছে ব্যাঙ্কে। উমা কিছু করতে পারেনি। এসব কথা শুনে শুনে উমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।
প্রথমদিকে এসব কথা শুনে তার মন খুব খারাপ হয়ে যেত। আজকাল আর যায় না। এরা কেউ তা মোটেও বোঝে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। সে শ্যামা দিদির চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। উমা এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলে না। দুঃখ ভরা মন নিয়ে প্রথমদিকে দিবাস্বপ্নে নিজের অগোছানো রুমে পড়ে থাকত একা একা।
বেশিরভাগ সময় কাজের চাপে তাদের বাবা বাইরে থাকে এবং যখন তিনি বাড়িতে আসেন তখন উমার খুব আনন্দ হয়। কারণ, বাবা তাকে কখনও দিদির সঙ্গে তুলনা করে কিছু বলে না।

বাবা যখন বাড়িতে থাকে, তখন তিনি নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অন্যদের ব্যাপারে তেমন নাক গলান না। তার হাতের কাজ শেষ হলে, তারপর রাতের খাবার খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ন এবং রাতের খাবারের পরে বাবা বিছানায় চলে যান। সে তাদের সাথে অকারণ বেশি কথা বলে তাদের বিরক্ত করেন না, বরং তাদের নিজেদের মতো থাকতে দেন।
বাবা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লে মা তখন তার মাথার পাশে বসে, তাকে অনেক কথাই বলেন। বাবা তা শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েন, মা সেটা বুঝতে পেরে সেখান থেকে তখন উঠে এসে রাতের খাবার বেড়ে, তাদের খাবার টেবিলে নীচু স্বরে ডাকেন যাতে বাবার ঘুমটা না ভেঙে যায়।
শ্যামা বন্ধুদের সাথে একা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। কিন্তু মা কিছুতেই উমাকে একা একা কোথায়ও ছাড়েন না । তাতে উমার মনে দুঃখ হয় বইকি। এই তো সেদিন উমার বন্ধুরা কয়েকজন মিলে ঘুরতে গেল দক্ষিনেশ্বর, ওরা ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মা কিছুতেই ছাড়লেন না। কী আর করবে সে? উমা ভাবে, যখন সে বড় হয়ে কলেজে পড়তে যাবে, তখন মা কি আর তাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারবে?

এইসব ভাবতে ভাবতে ভাবতে কখন সে তার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, টের পায়নি।

সকালে সে উঠে দেখল,আকাশ মেঘলা। কেমন একটা গুমোটভাব ঘরের মধ্যে ছড়িযে রয়েছে। বাবা কখন উঠে পড়ে দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, ড্রয়িংরুমে টেবিলে এসে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। মা রান্না ঘরে চা করছেন।
উমা দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে এসে জানলার কাছে বসে আকাশ দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল,
সামনের পেয়ারা গাছটাতে একটা কাক বসে, এক একবার কা কা রবে ডাকছে আর মাথা ঘুরিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে এদিক সেদিকে তাকাচ্ছে। জানলার কাছে বসা উমার সঙ্গে তার চোখাচুখি হতেই সে আবার কা কা করে ডেকে উঠল। উমার মনে হল, কাকটা যেন তার কাছে খাবার চাইছে। এমন সময় মা এসে তার সামনে টেবিলে এককাপ চা আর দুটি থিন এরারুট বিস্কুট রেখে গেল। উমা তার থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে কাকটা দিকে ছুড়ে দিল। কাকটা মুহূতে উড়ে এসে নীচে পড়ার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আবার গিয়ে গাছটার উঁচু মগডালে বসল। উমা দেখল সেখানে একটি কাকের বাসা। বাসার ভিতর থেকে একরত্তি একটা কাক তার মুখ হা করে, কা কা স্বরে মাকে ডাকছে। বাচ্চা কাকটার মুখের ভিতরটা লাল। কাকটা ঠোঁট দিয়ে বিস্কুটের টুকরোটা ভেঙে ভেঙে বাচ্চা কাকটা মুখে দিচ্ছে।
এই দৃশ্যটা দেখে তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার মাও তবে কাকের মতোন এমন ভাবে তার জন্য চিন্তা করে।
উমার স্বভাব স্কুল থেকে ফিরে, কাঁধের
ব্যাগটা নামিয়ে তার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলা। তারপর এক এক করে পোষাক খুলে যেখানে সেখানে রেখে চট করে বাথরুমে ঢুকে পড়া। বাথরুমে ঢুকে প্রথমেই আয়নায তার মুখটা দেখা। তারপর মগে করে জল নিয়ে মুখে জল ছিটিয়ে দিতে দিতে, শাওয়ারটা খুলে তার নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে সিক্ত করা। বাথরুম থেকে বেরতেই মা তাকে ডাক দিয়ে বলে, চলে আয় তোর ভাত বেড়ে বসে আছি আমি। উমা চটপট পোষাক পরে, মাথাটা কোন রকমে আচড়ে, খাবার টেবিলে চলে যায়। বোঝে পেটের ভিতরে ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন মারতে শুরু করেছে। তার মা কাকটা মতো তার মুখে খাবার তুলে দেয় না ঠিকই। তবে প্রতীক্ষায় থাকে কখন উমা ভাতের গ্রাসটা মেখে প্রথম মুখে তুলবে।
শ্যামার জন্য মার অতটা দুশ্চিন্তা নেই।কারন, সে নিজের খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে জানে। উমা সেটা পারে না।

চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ করে উমা, বই নিয়ে পড়তে বসল। একটু পরেই শুরু হল টিপ-টিপ করে বৃষ্টি পড়া। পড়ায় মন বসল না তার আর। ভাবল এসময় ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে দারুণ মজা হত। কিন্তু তার কী কোন উপায় আছে? মা জানতে পারলে তাকে আর আস্ত রাখবে না।
বলবে, ধেড়ে মেয়ে তোমার কি কোনদিন কোন বুদ্ধি-সুদ্ধি হবে না? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাজাতে চাও।

একটু পড়েই বৃষ্টির বেগ একটু একটু করে বাড়তে শুরু করল। উমা টেবিল থেকে উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিল। তারপর ভাবল, এই বৃষ্টিতে ভিজে কাকের বাচ্চাটার আবার জ্বর হবে না তো? এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকল। মাকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করবে কথাটা ভাবল। কিন্তু তার আগেই, উমা জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছে দেখে,মা আবার রান্না ঘরে চলে গেল। তাকে আর জিজ্ঞাসা করা হল না কথাটা।

মনে পড়ে গেল, উমা একবার মায়ের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়িতে, মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। মামাতো ভাইয়ের জন্মদিন ছিল। বাবা যেতে পারেনি, অফিসে কী একটা জরুরী কাজ ছিল। দিদির ছিল কলেজের পরীক্ষা। তাই তারও যাওয়া হয়নি। সেখানে গিয়েছিল উমা আর মা। বাবা স্টেশনে এসে, তাদের ট্রেনে তুলে দিতে গেছিলেন। কী ভিড় ছিল স্টেশনটায় , ভিড়ে গমগম করছিল। সব মনে পড়ে যাচ্ছে উমার। বাবা ট্রেনে তুলে দেবার সময় উমার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল।
ট্রেন চলতে শুরু করার একটু পরেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টি দেখে উমার মনটা আবার ভাল হয়ে গেল। বাবার জন্য মনখারাপের কষ্টটা ধুয়ে মুছে গেল। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ ঝলকে অদূরে ধানখেত চমকে চমকে উঠছিল। উমার মনকে টানছিল। বুষ্টি দেখতে দেখতে, সে মনে মনে বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়তে লাগল সবুজ ফসলে ঘেরা অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়ে।
মায়ের ডাকে তার সম্বিত ফিরল।
– তোর কি খিদে পেয়েছে? খাবি কিছু
– না মা। তুমি খেলে খেয়ে নাও,আমি এখন কিছু খাব না। পরে খাব।
বলেই উমা আবার বৃষ্টি দেখতে লাগল।
রাত দশটা নাগাদ তারা বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া রাতের খাবার লুচি-তরকারী আর দুটো করে কাঁচাগোল্লা খেয়ে শুয়ে পড়ল। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে উমা ঘুমিয়ে পড়ল।

মায়ের ডাকে, সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে যখন ওরা এনজিপি স্ট্যাশনে নামল। তখন ঝকঝকে আকাশ। উঁকি মেরে সূর্য যেন দেখছে তাদের। কারা নতুন এলো আবার এই শহরে?
কী যে ভাল লাগছিল এই নতুন পরিবেশে উমার তা আর বলার নয়। উমা চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, বিস্ময়ভরা চোখে মুখে সবকিছু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল । ততক্ষণে বড়মামা গাড়ি নিয়ে এসে গেছেন ওদের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য।
বড়মামা গাড়ির সমনের দিকে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসে তাদের দু’জনকে পিছনের সিটে উঠে বসতে বললেন। মা উমাকে নিয়ে পিছনের সিটে এসে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল ময়নাগুড়ির উদ্দেশ্যে।
দু’পাশে জঙ্গল মাঠ পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটছিল সামনের দিকে। কালো রাস্তা চাকার তলায় পিছলে পিছনে সরে যাচ্ছিল। উমা মুগ্ধ চোখে সেই পরিবেশ দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে রইল। মা বড় মামার সাথে মাঝে মাঝে তখন কথা বলছিল। সে আওয়াজও কানে আসছিল উমার। কিন্তু কী কথা বলছিল, মায়ের পাশে বসেও উমা সেটা শুনতে পারছিল না।
৷ হটাৎ আমার একটা বন-মুরগী গাড়ির সমনে এসে পড়ায় ড্রাইভার আচমকা গাড়িটা থামাল।
সকলে সামনে ঝুঁকে পড়ল। উমার বিহ্বলতা ভাঙল মুহূর্তে।
বন-মুরগীটা আবার উড়ে উল্টোদিকের জঙ্গলে চলে গেল। ড্রাইভার তিনবার কপালে হাত ঠেটিয়ে প্রণাম জানিয়ে আবার গাড়ি চলাতে শুরু করল।
দশটা নাগাদ তারা মামাবাড়িতে এসে পৌঁছাল। কাল মামাতো ভাইয়ের জন্মদিন। বাড়িতে সাজসাজ রব। বড় মামিমা তাদর দেখে উচ্ছসিত হয়ে পড়লেন। মাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। উমাকে হাত ধরে আদর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
একটু পড়েই তাদের জন্য চা-জলখাবার এলো।
খাবার দেখে উমার ক্ষিদেটা যেন চাগিয়ে উঠল। এতক্ষণ ছিল না। বড় মামিমার কাছে বাথরুমটা কোনদিকে জেনে, উমা সেখানে গিয়ে
সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এসে, চা জলখাবার খেতে শুরু করল।
চা জলখাবার খেতে খেতে উমার চোখ গেল,
বারান্দায় খাঁচায় ঝুলতে থাকা, লাল ঠোঁটঅলা সবুজ রঙের টিয়া পাখিটার দিকে। উমা একছুটে খাঁচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিটা এতক্ষণ
উমার দিকে লেজ ঘুরিয়ে বসে ছিল। উমা কাছে যেতেই, তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আপাদমস্তক দেখল তাকে? তারপর বলে উঠল, কে তুমি? কি নাম।
উমা বলল, উমা।
পাখিটাও বলে উঠল, উ ম্ ম্ ম্ মা
শুনে উমার খুব হাসি পেল। খুশিতে লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিয়ে উঠল।
মা তখনই তাকে ডাকল, আয় মা, চা জলখাবারটা খেয়ে যা। এসবগুলি যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
উমা পাখিটাকে টা টা বলে মায়ের কাছে ফিরে গেল। ফিরে যেতে যেতে উমা শুনতে পেল, পাখিটাও স্পষ্ট স্বরে বলছে, টা টা

উমা চা জলখাবার খেতে খেতে বলল, আচ্ছা মা টিয়া পাখিটা যেমন কথা বলতে পারে, একটা কাককে খাঁচায় পুষে, তাকে শেখালে কি কাকটাও টিয়া পাখিটার মতো কথা বলতে পারবে?
মা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, জানি না বাপু। তোর যতসব বিদখুঁটে প্রশ্ন।
উমা আর কথা বাড়াল না। চা জলখাবার শেষ করে আবার পাখিটার সামনে এসে দাঁড়াল।

ওখানে চারদিন ছিল উমারা। বেশ মজায় কেটেছে দিনগুলি। পাখিটার সঙ্গে উমার বন্ধুত্ব হয়েগেছিল। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে পাখিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, পাখিটা উ ম্ ম্ ম্ মা – উ ম্ ম্ ম্ মা – উ ম্ ম্ ম্ মা ডেকে উঠত। উমা মামিমার কাছ থেকে পাকা লঙ্কা চেয়ে এনে খাওয়াত। একদিন খাঁচার ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে একটা পাকা লঙ্কা দিতেই, পাখিটা এমন ছোঁ মেরে এসে লঙ্কাটা নিল, উমার আঙুলও লঙ্কা ভেবে কামড়ে ধরে ছিল। পরে ভুল বুঝতে পেরে বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে শেষে।
মা দেখে বলেছিল, বেশ ভাল হয়েছে। ঢিঙি মেয়ে আরও আদর করে গিয়ে পাকা লঙ্কা খাওয়া। আমাকে এসব দেখাতে আসবি না। মা রাগে গজগজ করে উঠেছিল। উমা জানে ওর কোন দোষ ছিল না। বোঝার ভুল ছিল শুধু।

এইসব ভাবতে ভাবতে উমার মনেহল, কাকের বাচ্চাটাকে এনে পুষলে কেমন হয়? সে তাকে কথা শেখাবে। শিখতে পারবে কিনা সেটা পরে দেখা যাবে।
কাকটাকে খেতে দেবার ঝামেলা নেই।
ঘরের ফেলে দেওয়া এঁটোকাটা দিয়েই তার পেট ভরে যাবে। নোংরা পরিস্কার সে না হয় নিজেই করে নেবে রোজ দুপুরে স্নানের আগে।
ভাবল বাবার কাছে সে প্রস্তাবটা রাখবে।
মা দিদি রাজী হবে না, উমা জানে। ওরা বলবে, ও সব উটকো ঝামেলা ঘরে কেন? তোমার কি খেয়ে-দেয়ে আর কোন কাজ নেই। একমাত্র বাবাকেই বলা যায়।
কাল সকালে বাবাকে কথাটা বলতে হবে। আজ বাবা খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছেন। মা দিদি আর সে একসঙ্গে খেতে বসেছে। খাওয়া-দাওয়া সেরে সে ঘরে চলে গেল। একটু পরে এলোমেলো বিছানাটা একটু গুছিয়ে নিল। তারপর বিছানার চাদরটা তুলে ঝেরে নিল। তারপর বালিশ পাশ-বালিশ বিছানায় নিয়ে নীল নাইট বাল্পটা জ্বেলে, বড় আলোটা নিভিয়ে, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। বাবা যদি রাজী হয়, তবে মা আর দিদি আপত্তি করে কিছু করতে পারবে না।
তখন সে কাকটাকে কী খেতে দেবে? কী ভাবে যত্ন নেবে ভাবতে লাগল। প্রথম কী কথা শেখাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল টের পায়নি মোটেও।

উমা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, বাবা খাঁচায় করে তার জন্য একটা সাদা কাক নিয়ে এসেছে। তা দেখে উমার মনে খুশি আর ধরে না,
আনন্দে সে লাফাতে লাফাতে এসে খাঁচাটার সামনে দাঁড়াল। পরক্ষণেই তার মনেহল, কই বাবাকে তো সে বলেনি, তার কাক পোষার শখ।
তাহলে বাবা কী করে তার মনের কথা জানতে পারল। যাক্ গে ওসব কথা ভেবে লাভ নেই।
সে বাবাকে বলে খাঁচাটাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মা দিদিকে দেখাবার ইচ্ছে হল না। ওদের দেখালেই, মা বলবে, ছিঃ ছিঃ এটা তোর বাবা কী এনেছে। বাড়িত একটা কাক ঢুকিয়েছে? তোর বাবার কী আক্কেল বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে?
দিদি আবার তা শুনে বললে, বাবা ওই রকমই।
উমা, না চাইতেই সব পেয়ে যায়। আর আমার বেলা?
উমার বলতে ইচ্ছে হয়, তাতে তোর কী? তোর হিংসে হয়? কিন্তু মুখে কিছু বলে না সে। আর মা তো শ্যামার কোন ব্যাপারে দোষ দেখে না। আর উমা যাই করে, সেটাই দোষের হয়ে যায় মার কাছে। বাবা তেমনটা নয়। বাবা সব বোঝে। এইজন্য বাবাকে উমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে, বাড়ির সকলের মধ্যে।

উমা খাঁচাটা ঘরে এনে, পড়ার টেবিল থেকে তার বই-খাতা সরিয়ে দিয়ে সেখানে রাখল।
দেখল, সাদা কাকটা তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাথাটা কাৎ করে দেখছে। কী সুন্দর দেখতে কাকটা। সাদা ধবধবে দেখতে, একবারে সাহেবদের মতো।
উমা বলল, নাম কী তোমার?
কী আশ্চর্য কাকটাও তার মতো কথা বলে উঠল, – তোমার নাম কী?
– আমার নাম উমা।
– আমার নাম তবে ঝুমা
– মানে?
– আগে আমার কোন নাম ছিল না। আজ থেকে ঝুমা নাম হবে আমার।
– বাঃ বেশ বলেছো তো। উমার সঙ্গে মিলিয়ে ঝুমা।
কাকটা শুনে বলল, তুমি খুশি হয়েছো?
উমা টেনে টেনে সুর করে বলল, – খুব খুশি ঝুমা।
– আমার একটা পাজি দিদি আছে, তার নাম শ্যামা।
– বেশ, আমি তবে তার সঙ্গে কথা বলব না। আড়ি আড়ি আড়ি। তিন আড়ি।
উমা বলল, ভেরি গুড ঝুমা। তারপর উমা আবার বলল, – তোমার বাবা মার কথা মনে পড়ে ঝুমা? বলে উমা সাদা কাকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
– বাবার কথা জানি না। তবে মার কথা আবছা আবছা মনেপড়ে আমার। মা উড়ে ইড়ে খাবার জোগাড় করে এনে আমার মুখে গুঁজে দিত।
উমা এটা দেখেছে সেদিন। উমার মনে পড়ল।
উমা বলল, তারপর?
– তারপর আমি যেদিন উড়তে শিখলাম,মাকে কোথায় হারিয়ে ফেললাম।
উমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, আহারে!
– আহারে! কেন? সাদা কাক জানতে চাইল।
– তার মানে তুমি একেবারে একা হয়ে গেলে।
– হ্যাঁ, তা বলতে পার।
– তবে একটা ব্যাপার ভাল, উমা বলল, মা তোমার কোন কাজে বাধা দিতে পারত না। তুমি স্বাধীন ছিলে।
– একদম। কেউ আমার কোন ইচ্ছেয় কখনও বাধা দিত না। আমি স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতাম। তোমাদের মানুষের মতো আমাদের পাখির সমাজ সংসারে পরাধীন নয়।
– কী মজা, কী মজা , বলে উমা লাফিয়ে উঠল।
তাবপর বলল, দাঁড়াও তোমার খাবার জন্য দুধ রুটির ব্যবস্থা করি।
সাদা কাকটা বলল, আমি রুটি খাব শুধু। দুধটা তুমি খেয়ে নিয়ো।
– কেন?
– আমি তো ঠোঁট দিয়ে দুধ খেতে পাবর না।
– ও আচ্ছা। মা তাহলে আমাকে চা-বিস্কুট দিতে এলে তোমাকে বিস্কুটটা দিয়ে, আমি চা-টা খাব।

এমন সময় মায়ের ডাকে উমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মা বলল, উমা ওঠ, ওঠ।উঠে পড়।
উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে নে, তোর পড়ার টেবিলে রেখে গেলাম।
উমা ঘুম ভেঙে চোখ ডলতে ডলতে অবাক চোখে দেখল, কোথায় টেবিলে সাদা কাকের খাঁচাটা। সেখানে বই-খাতা যেমন ছড়ানো ছিল, তেমনই আছে। মা সেগুলি একটু সরিয়ে, কোন রকমে তার মাঝখানে তার চায়ের কাপ দিস রেখে দিয়ে গেছে।

উমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বুঝল, সে এতক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিল। আরও বেশি খারাপ লাগল, এই ভেব যে ঝুমাকে বিস্কুট খেতে দেবে কথা দিয়েও, সে সেকথা রাখতে পারল না।
উমা হাত-মুখ ধুয়ে এসে, কাপ থেকে চুমুক দিয়ে শুধুে চা-টুকুই খেল। আর বিস্কুট দুটো ঝুমার নাম করে জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ২২ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন