শান্তিপুর — একটি ছোট গ্রাম, যেখানে সময় যেন ধীরে ধীরে বয়ে যায়। গ্রামের মানুষগুলো সবসময়ই ব্যস্ত অনুপমকে নিয়ে কথা বলায়। “অনুপম প্রেমের রোগে আক্রান্ত পাগল,” তারা বলত। কিন্তু অনুপম জানত, মানুষ শুধু চোখে যা দেখে, তার ওপর বিচার করে। তার হৃদয় জানত — সত্যি ভালোবাসা কখনো দৃশ্যমান হয় না।
অনুপমের অপরাধ একটাই—সে ভুলতে পারেনি শৈশবের বন্ধু শ্রেয়াকে। পাঁচ বছর আগে শ্রেয়া চলে গিয়েছিল বাবার বদলির চাকরিতে দূরের শহরে। কোনো ঝগড়া হয়নি, কোনো মনোমালিন্যও নয়। বাস্তবের বাধ্যবাধকতা শুধু দু’জনকে আলাদা করেছিল।
গ্রামবাসী বলত,
> “চলে গেছে তো গেছে। নতুন জীবন শুরু করো, বিয়ে করো।”
অনুপম হেসে বলত,
> “যে হৃদয় একবার সম্পূর্ণভাবে প্রেমে নিবেদিত, তাকে সময় বা দূরত্ব কোনোদিন বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।”
তার মনে ঘুরত অন্য একটি উক্তি, যা সে নিজেকে বারবার বলত:
“যে মানুষ নিজের অন্তরের ভয়কে জয় করতে পারে, সে বাস্তবের যেকোনো বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।”
দিনের বেলা সে পুরোনো লাইব্রেরির এক কোণে বসে থাকত। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে স্মৃতি খুঁজত, অতীতের খোলসের ভেতর লুকিয়ে থাকা মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে ধরত।
সন্ধ্যা নামলেই তার ঘরের জানালার পাশে রাখা ফাঁকা চেয়ারটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। চারপাশের মানুষের শব্দ কানে বাজলেও, তার মন শুধু সেই সুর গুনগুন করত যা শুধুই তার আর শ্রেয়ার।
“নীরবতা কখনো শূন্য নয়; সেখানে লুকিয়ে থাকে হৃদয়ের অদৃশ্য শক্তি।”
এক পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলো ঘর ভেসে দিল। গ্রামের মোড়লের ছেলে এসে বলল,
> “অনুপম দা, শুনলাম আপনি এখনও শ্রেয়াকে চিঠি লেখেন। লোকে হাসছে, নাম খারাপ হচ্ছে।”
অনুপম তার হাতে থাকা পুরোনো ডায়েরিটা খুলল। প্রতিটি পাতায় ছিল শ্রেয়ার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তের গল্প, হাসি, কথা, ছোটখাট সব ঘটনা।
সে বলল,
> “লোকের কথা কি হৃদয়কে মিথ্যা বলতে বাধ্য করে? যে নাম হৃদয়ে খোদাই করা, তাকে কি মুছে ফেলা যায়?”
সে আরও একবার বলল নিজের মনের গভীরতা থেকে:
“যে ব্যক্তি নিজের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতক হয় না, তার জন্য কোনো সমাজিক সমালোচনা শক্তিশালী নয়। আমি যদি বিশ্বাস করি, আমি বাঁচব, আমি লিখব, আমি প্রেম করব।”
ছেলেটি কিছু বলতে পারল না। অনুপম হেসে বলল,
> “নিন্দুকেরা হোক যতই—হাসুক বা বলুক। প্রেম কেবল দুজনের, সমাজের নয়। দূরত্ব শুধু দেহকে আলাদা করতে পারে, হৃদয়কে নয়।”
রাত্রি গভীর হলো। অনুপম তার ডায়েরি বুকের কাছে টেনে লিখল:
> “শোনো, যার কথা মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে, তাকে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমার প্রতিদিনের লেখাগুলোই আমার প্রেম। আমার স্মৃতিগুলো আমার ঘর। এই ঘর আমি কারো কথার ভয়ে অন্ধকার করতে পারব না।”
ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল:
> “লোকে ভুলতে বলুক, নিন্দুকেরা হাসুক। তুমি চিরন্তন। তুমি শুধু স্মৃতি নও, তুমি আমার লেখার প্রেরণা, আমার বেঁচে থাকার কারণ। এই কারণেই আমি কাউকে পরোয়া করি না। কারণ, আমার গল্পটা কেবলই আমার, আর তোমার।”
বছর পরে, সেই ডায়েরি প্রকাশিত হলো ‘স্মৃতির ঠিকানা’ হিসেবে।
গ্রামবাসী বুঝল—কিছু সম্পর্ক কেবল হৃদয়ে বাঁচে, যা সমাজের নিয়মের ঊর্ধ্বে। আর সেই ভালোবাসা, যা লোকনিন্দার ভয়ে হার মানে না, সেটাই খাঁটি।
শেষ কথা বলতে গেলে, অনুপমের অন্তরের সেই উক্তি যেন চিরকাল ধরে ওঠে:
> “যে ব্যক্তি নিজের হৃদয়কে অনুসরণ করতে সাহসী, সে কখনো হারায় না।”
নিরুদ্দেশ চিঠি।
৬৩

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন