বস্তিউজাড়
আহমদ ছফা
প্রাণ ধারণের টানে দলে দলে গ্রামীণ মানুষ
চৌদ্দ পুরুষের ভিটি লাঙলের মায়া
মাটির নিবিড় টান—শরিকী বিবাদ
গরুর মুতের ঘ্রাণ, বীর হানিফার সেই
পুঁথির জগত আর জ্যোস্নালোকে ভাসমান
কন্যা সোনাভান সমস্ত পেছনে রেখে
মধুতে পিঁপড়ের মত
এ শহরে ভির করে বেঁধে আছে নীড়।
.
কার ছেলে কার নাতি কে রাখে হিসেব
ট্রেনে চেপে বাসে চড়ে, লরীতে নৌকোয়
আঁকাবাঁকা হাঁটা পথে, দুর্ভিক্ষের থাবা দেখে
জুঞ্জুল বাঘের মত বেরহম ক্ষুদার পীড়নে
অজন্মার অত্যাচারে, বন্যার ডাকাত স্রোতে
ভেসে ভেসে পাহাড়ি আগাছা প্রায়
ভ্রষ্ট নীড় গ্রামীণ মানুষ
রসাল গল্পের মত মুগ্ধ চোখে পড়েছে শহর।
.
আলোকের মালা জ্বলে, রাজপথ ফুল্লমুখী
পরীদের ঝাঁক, দুপুর বিকেল কেমন মাতিয়ে রাখে
শ্রীচরণে স্পন্দমান সঙ্গীতের তান।
বাষ্প হাওয়া জল আর আসমানের চঞ্চল বিজুলি
বিনীত সেবক সেজে এ শহরে দিচ্ছে অঞ্জলি
গাড়ি ঘোড়া বেগে ধায়, কল টিপে জল
হাওয়া ঝরে হাওয়া-কলে
আঙুলের মত সুখ থোকা থোকা ঝুলছে শহরে
শহর চমৎকার।
.
মা-হারা সন্তান প্রায় গ্রামহীন মানুষেরা এসে
জড়ো হয় শহরের ফাঁকা মাঠে সভ্যতার কীট
বারোয়ারি প্রয়োজনে প্রাণে প্রাণে গিঠ
বেঁধে বাঁশ কাঠে গড়ে তোলে নড়বড়ে নতুন নিবাস।
.
মিন্তি কেউ মোট বয়, রিকশা টানে
যোগালির কাজ করে অফিসে আর্দালী
এটা আনে সেটা বেচে, ছাতা মেরামত করে খায়
প্রকাণ্ড চাবির রিং ঘুরে ঘুরে ঝিমঝিম দুপুরে বাজায়,
গহনরাতের চোর, সুদক্ষ জুয়ারি ভাগ্যবান কেউ কেউ
পকেটে চালায় কাচি, বেশ্যার দালালি করে
কালো সন্ধেবেলা। সোমত্ত সধবা দল মাতারির
কাজ করে গিয়ে বাড়ি বাড়ি, রান্না করে
আবিয়েতা মেসে—মেসজীবী সাহেবেরা
অবসরে শিখে নেয় ডাগর-ডোগর প্রেমের সুমধুর পাঠ।
ধর্মভীরু আছে কেউ, হাওয়ায় অমঙ্গল দেখে দুবেলা রাঙিয়ে চোখ
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে করে ওঠে অসার তর্জন, মিলাদ লাগায় জোরে
গোটা রাত ভোর ধর্মকণ্ঠে ঝরে একটানা অশান্ত চ্যাঁচানি।
মানে না বারণ তবু পাপস্রোত হু হু করে বাড়ে
যেমন নদীর জলে লেগেছে জোয়ার।
মাঝে মাঝে মারামারি চাঁটগা কিংবা নোয়াখালী
বরিশাল ফরিদপুর ইত্যাকার নামগুলো
জ্বল জ্বল জ্বলে ওঠে মানে না শাসন
একটুও আশ্চর্য নয় দুয়েকটা হয়ে যায় আচমকা খুন।
.
এই তো জীবনরঙ্গ কিষাণের স্বপ্নের শহর
এখানে জীবন কাটে স্বপ্নহীন, তবু আছে স্বপ্নের তলানি
রাঙা বুদবুদের মত প্রাণের গভীরতল ভেদ করে
জেগে ওঠে জীবনের অন্তহীন আকাঙ্খার ফুল,
বস্তিতেও সঙ্গীত শিহরে, বুকে বুকে ভালবাসা
জোনাকির মত ভিড় করে
নিবিড় নিদ্রার পটে ছেড়া কাঁথা ফুঁড়ে
কম্পিত নক্ষত্র-শিখা স্বপ্ন হয়ে ঝরে।
.
মুলিবাঁশ দিয়ে গড়া খোপ খোপ ঘরগুলো
যেন মধুচক্র, ভরে রাখে শিশুকণ্ঠ নারীর কাকলি
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না পালাক্রমে করে লুকোচুরি
হাজার নালিশ তবু, ঘরকান্না চলে নিরিবিলি।
চারদিকে মন্বন্তর দেশ জুড়ে সেয়ানা আকাল
তেলে ঘিয়ে একদর, মৃত্যু কি জীবন ভাল
পায় না তো খুঁজে কেন তাল। বড়বেশি চোখাস্বরে
হাওয়ায় চিৎকারে ভাসে রক্তময় যুগের রোদন
বস্তিবাসী মানুষের চোখে ঘন পিচুটির মত
হতাশার গাঢ় আবরণ ক্রমে ক্রমে শক্ত হয়ে জমে।
.
মৃত্যু কিংবা জীবনের গন্তব্যবিহীন—এইসব গ্রামহারা মানুষের মনে
কখনো-সখনো হানা দেয় বেপরোয়া দামাল জীবন,
চঞ্চল স্রোতের বেগে জেগে ওঠে অগণন মানুষের সারি
সম্মুখে ধাবিত হয়, বিক্ষোভে মুখিয়ে ওঠে
ঝাণ্ডা তোলে হাতে চ্যাংড়া শোলের মত
লাফ দিয়ে প্রখ্যাত নেতার নামে করে জয়ধ্বনি—
শতবর্ষ বেঁচে থাক তুমিই ধর্মের বাপ তুমি মা জননী।
জ্বলজ্বলে তাজা স্বপ্ন রক্ত বমনের মত
উত্তাপিত কণ্ঠস্বরে বৃথা শুধু ঝরে।
শত্রুর শঠতাচক্রে বিশ্বেসকে করে বলাৎকার
মিথ্যে দেবতার স্তবে হৃদয়ের উজ্জ্বল কুসুম
ছিঁড়ে খুঁড়ে অর্ঘ্য দিয়ে—ঘরে এসে
নিরুত্তাপ নারীর শরীর জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে।
.
এইসব মানুষেরা পথে পথে ভাসন্ত শ্যাওলা
জীবনের খরস্রোতে নেহায়েত খড়কুটো মানবিক বন্ধনবিহীন
মরুতে উদ্যানকুঞ্জ ছায়াময় ধর পাবে কই?
ঘর—সে তো অতীতের সুখস্বর্গ স্মৃতি, কদলী তরুর ঝোপ
নারকোলের হেলে পড়া ছায়া, আম কাঁঠালের বনে
নবীন ফাল্গুনে জাগা কচি কচি পল্লবের মায়া
কাকচক্ষু সরোবর মুগ্ধ চোখে আকাশ নেহারে
নদীর বঙ্কিম ধারা, বাছুরের হাম্বারব
হেমন্তে মাঠের বুকে সোনারঙ্গ ধানের জোয়ার।
নির্বাক মৃত্তিকাতলে নিরিবিলি নিদ্রা যায়
উর্দ্ধতন চতুর্দশ পুরুষের প্রাণ, রত্নের ভাণ্ডার যেন
কোলে করে শুয়ে আছে দীনহীন সরল কবর।
ঘর নেই, তবুও ঘরের মায়া প্রাণে বিঁধে আছে সর্বক্ষণ
স্বপ্নে শোনে পিতৃপুরুষের স্বর, শোনে দেয়ার গর্জন
নদীর ছলছল স্রোত চোখে ভাসে, নতুন ধানের ঘ্রাণ
মগজের কোষে, সমীরিত মাঠ জাগে মনে
রক্তের স্পন্দনে বাজে বৃষ্টির ঝঙ্কার।
শহরের ফাঁকামাঠে বাঁশে কাঠে গড়ে তারা
ঘর নয়, ঘরের বিদ্রূপ—হাওয়ার দাপটে কাঁপে
এলোকেশী বৈশাখের ঝরে ছত্রখান, মাঘের দীঘল রাতে
হিমেল ভালুক ঢুকে বিঁধায় নখর
উদ্বাস্তু গ্রামের লোক বেআব্রু জীবন
বেঁধে রাখে যেইখানে অতিকষ্টে মনে করে ঘর।
.
ধীরে ধীরে পেকে উঠে আসন্ন সময়, একদিন
বস্তিবাসী মানুষের চোখে টুটে ঘুম, অলক্ষে ওপর হতে
জরুরী হুকুম নেমে এল, হঠাৎ জঞ্জাল সব রাবিশের স্তুপ
নগরী নিশ্চিত হোক, চাঁদের কলার মত বাড়ুক লাবণী।
কেননা সংবাদ গেছে এইসব বস্তির মজুর
ফিরিঅলা মিস্তিবাহাদুর একজোটে ফন্দি আঁটে
প্রথম সুযোগে নাকি বিস্ফোরণে ফাটাবে শহর;
নীল আসমানের থেকে অগ্নিময় বজ্র টেনে
নিষ্ঠুর নগর বক্ষে ঢালবে কহর। গ্রাম খারিজের
শোধ নেবে, সোনালী শস্যের নামে লাগাবে তাণ্ডব
বইয়ে দেবে রক্ত নদী, লালে লাল হবে রাজপথ
ক্ষেপা তরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে
খুলে নেবে সভ্যতার ফ্যাকাশে বল্কল।
পাড়ায় পাড়ায় চলে প্রদীপ্ত মহড়া, কারা নাকি
নীল-নকশা লেখে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে
শোণিতের মত লাল ফুটন্ত সকাল কারা নাকি
টেনে আনে, অমর আশার তরুহিম্মতে
রোপন করে বজ্রাহত হৃদয়ের তলে, আঁটে ছল।
অগুণতি মেষের শিশু নখে-দন্তে হয়ে ওঠে খল
কি জানি কখন, তরুণ সিংহের মত একসঙ্গে করে বসে প্রচণ্ড গর্জন।
.
চারিদিকে চাপা ভয়, বাতাসে ব্যাকুল ঝরে
তুমুল রটনা, এই বুঝি প্রকম্পনে ফেটে গেল শিলা
মাটির জমাট কান্না মুক্তি পেয়ে হয়ে গেল
বীর্যবান জীবন সঙ্গীত
ঝাঁঝরা বুকের তলে হৃদপিণ্ড বাজে এযন জঙ্গের দামামা।
ইত্যাকার বার্তা শুনে বুলডোজারেরা এল
নরম মাটির বুকে এঁকে দিল সুগভীর দাগ
ক্ষুব্ধ রুষ্ট লোহার গণ্ডার, ঘুমভাঙ্গা কুম্ভকর্ণ
অন্ধরাগ নির্মম হিংসায় ছোটে ছোটে স্নেহনীড়ে
তুলে দিল ক্ষমতার ভার
দলামোচা হয়ে ভাঙে ঘরহার মানুষের ঘর।
.
অস্থিচর্মসার ন্যাংটো কালো কৌতুহলী শিশু
দেখল অবাক চোখে মানুষের আরো এক লুকোনো স্বরূপ
মারণাস্ত্রে তাক করা কালো কালো চোখ
লাজুক পাখির তুল্য নির্বাক রমণী
নিষ্প্রাণ চিত্রের মত নিথরে দাঁড়িয়ে আছে, জানে না
শুকোলো কবে অশ্রু উৎসে পানি।
বুড়োরা ঠোঁটের ফাঁকে বিড়বিড় করে উচ্চারণ
খণ্ডাতে পারে না কেউ ললাট লিখন।
অধোমুখে অপরাধী যুবাদের দল নির্বিকার সহ্য করে
বড় ব্যথা, যেন জীবন্ত ছাগল থেকে তুলে নেয় খাল।
বস্তির কুটুম সেই নির্লজ্জ কুকুর
মোটা তাজা হাড় ফেলে ঘুরে ঘুরে জুড়েছে চিৎকার।
শালিক ব্যথিত অতি ভুলে গেছে কথা
সুঠাম শিমুল তরু প্রসারিত ছায়া মেলে করে আছে চুপ
আবেগে কুসুমদল লাল অশ্রুকণা হয়ে ঝরে।
কাঁথা-বালিশের স্তুপ, হাড়ি কুড়েঘরের ভেজানো ঝাপ
খাঁচায় পোষিত পাখি, বাসন-কোসন
বালতি-মগ-হ্যারিকেন, সন্ধের চেরাগবাতি
আকাশে চক্কর দেয়া ডোরা-কাটা শান্ত কবুতর
দিশেহারা দুগ্ধবতী ছাগল জননী
দুঃখী মানুষের দুঃখে তোলে আর্তধ্বনি।
.
বাসাভাঙা পাখি প্রায় তাড়াখাওয়া গ্রামীণ মানুষ
কুয়াশার পথ বেয়ে কোন্ দিকে যায়?
কম্পিত চরণ পাতে কোন্ কথা লিখে রাখে পাথুরে রাস্তায়?
জাগ্রত হৃদপিণ্ডতলে বিদ্যুৎ চমকে
সর্বহারা হৃদয়ের অগ্নিগর্ভ বাণী
হাড়ে হাড়ে বহ্নিমান কথার ফোয়ারা
সমাচ্ছন্ন অন্ধকারে কি আবেগে ফেটে পড়ে।
মমতার লেশহীন গর্বময়ী নিষ্ঠুর শহর
ক্ষমতার ক্রীড়াক্ষেত্র অবশ্য তোমাকে দেব
দরিদ্রকে ছলনার বর, আমরা যাব না গ্রামে
শিশু কি কখনো যায় মাতৃজরায়ণে?
দলিত মথিত হব হাড়ে হাড়ে পিষ্ট হব
বিষাক্ত ভীমরুল প্রায় গুপ্তঘরে
সারারাত করে রবো চুপ।
রজনী প্রভাতকালে বহির্গত হব সব
যেন ঝাঁক ঝাঁক বোমারু বিমান।
হে শহর গর্বোদ্ধত নিষ্ঠুর শহর
তোমার সঙ্কীর্ণ বক্ষে সবান্ধবে একদিন
ঢেলে দেব মারাত্নক আজব কহর
গ্রাম খারিজের শোধ নেব, সোনালী শস্যের
নামে লাগাব তাণ্ডব, বইয়ে দেব রক্তনদী
লালে লাল হবে রাজপথ, ক্ষেপাতরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে
খুলে নেব সভ্যতার বল্কল।
.
(দুঃখের দিনের দোহা কাব্যগ্রন্থ থেকে)
চৌদ্দ পুরুষের ভিটি লাঙলের মায়া
মাটির নিবিড় টান—শরিকী বিবাদ
গরুর মুতের ঘ্রাণ, বীর হানিফার সেই
পুঁথির জগত আর জ্যোস্নালোকে ভাসমান
কন্যা সোনাভান সমস্ত পেছনে রেখে
মধুতে পিঁপড়ের মত
এ শহরে ভির করে বেঁধে আছে নীড়।
.
কার ছেলে কার নাতি কে রাখে হিসেব
ট্রেনে চেপে বাসে চড়ে, লরীতে নৌকোয়
আঁকাবাঁকা হাঁটা পথে, দুর্ভিক্ষের থাবা দেখে
জুঞ্জুল বাঘের মত বেরহম ক্ষুদার পীড়নে
অজন্মার অত্যাচারে, বন্যার ডাকাত স্রোতে
ভেসে ভেসে পাহাড়ি আগাছা প্রায়
ভ্রষ্ট নীড় গ্রামীণ মানুষ
রসাল গল্পের মত মুগ্ধ চোখে পড়েছে শহর।
.
আলোকের মালা জ্বলে, রাজপথ ফুল্লমুখী
পরীদের ঝাঁক, দুপুর বিকেল কেমন মাতিয়ে রাখে
শ্রীচরণে স্পন্দমান সঙ্গীতের তান।
বাষ্প হাওয়া জল আর আসমানের চঞ্চল বিজুলি
বিনীত সেবক সেজে এ শহরে দিচ্ছে অঞ্জলি
গাড়ি ঘোড়া বেগে ধায়, কল টিপে জল
হাওয়া ঝরে হাওয়া-কলে
আঙুলের মত সুখ থোকা থোকা ঝুলছে শহরে
শহর চমৎকার।
.
মা-হারা সন্তান প্রায় গ্রামহীন মানুষেরা এসে
জড়ো হয় শহরের ফাঁকা মাঠে সভ্যতার কীট
বারোয়ারি প্রয়োজনে প্রাণে প্রাণে গিঠ
বেঁধে বাঁশ কাঠে গড়ে তোলে নড়বড়ে নতুন নিবাস।
.
মিন্তি কেউ মোট বয়, রিকশা টানে
যোগালির কাজ করে অফিসে আর্দালী
এটা আনে সেটা বেচে, ছাতা মেরামত করে খায়
প্রকাণ্ড চাবির রিং ঘুরে ঘুরে ঝিমঝিম দুপুরে বাজায়,
গহনরাতের চোর, সুদক্ষ জুয়ারি ভাগ্যবান কেউ কেউ
পকেটে চালায় কাচি, বেশ্যার দালালি করে
কালো সন্ধেবেলা। সোমত্ত সধবা দল মাতারির
কাজ করে গিয়ে বাড়ি বাড়ি, রান্না করে
আবিয়েতা মেসে—মেসজীবী সাহেবেরা
অবসরে শিখে নেয় ডাগর-ডোগর প্রেমের সুমধুর পাঠ।
ধর্মভীরু আছে কেউ, হাওয়ায় অমঙ্গল দেখে দুবেলা রাঙিয়ে চোখ
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে করে ওঠে অসার তর্জন, মিলাদ লাগায় জোরে
গোটা রাত ভোর ধর্মকণ্ঠে ঝরে একটানা অশান্ত চ্যাঁচানি।
মানে না বারণ তবু পাপস্রোত হু হু করে বাড়ে
যেমন নদীর জলে লেগেছে জোয়ার।
মাঝে মাঝে মারামারি চাঁটগা কিংবা নোয়াখালী
বরিশাল ফরিদপুর ইত্যাকার নামগুলো
জ্বল জ্বল জ্বলে ওঠে মানে না শাসন
একটুও আশ্চর্য নয় দুয়েকটা হয়ে যায় আচমকা খুন।
.
এই তো জীবনরঙ্গ কিষাণের স্বপ্নের শহর
এখানে জীবন কাটে স্বপ্নহীন, তবু আছে স্বপ্নের তলানি
রাঙা বুদবুদের মত প্রাণের গভীরতল ভেদ করে
জেগে ওঠে জীবনের অন্তহীন আকাঙ্খার ফুল,
বস্তিতেও সঙ্গীত শিহরে, বুকে বুকে ভালবাসা
জোনাকির মত ভিড় করে
নিবিড় নিদ্রার পটে ছেড়া কাঁথা ফুঁড়ে
কম্পিত নক্ষত্র-শিখা স্বপ্ন হয়ে ঝরে।
.
মুলিবাঁশ দিয়ে গড়া খোপ খোপ ঘরগুলো
যেন মধুচক্র, ভরে রাখে শিশুকণ্ঠ নারীর কাকলি
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না পালাক্রমে করে লুকোচুরি
হাজার নালিশ তবু, ঘরকান্না চলে নিরিবিলি।
চারদিকে মন্বন্তর দেশ জুড়ে সেয়ানা আকাল
তেলে ঘিয়ে একদর, মৃত্যু কি জীবন ভাল
পায় না তো খুঁজে কেন তাল। বড়বেশি চোখাস্বরে
হাওয়ায় চিৎকারে ভাসে রক্তময় যুগের রোদন
বস্তিবাসী মানুষের চোখে ঘন পিচুটির মত
হতাশার গাঢ় আবরণ ক্রমে ক্রমে শক্ত হয়ে জমে।
.
মৃত্যু কিংবা জীবনের গন্তব্যবিহীন—এইসব গ্রামহারা মানুষের মনে
কখনো-সখনো হানা দেয় বেপরোয়া দামাল জীবন,
চঞ্চল স্রোতের বেগে জেগে ওঠে অগণন মানুষের সারি
সম্মুখে ধাবিত হয়, বিক্ষোভে মুখিয়ে ওঠে
ঝাণ্ডা তোলে হাতে চ্যাংড়া শোলের মত
লাফ দিয়ে প্রখ্যাত নেতার নামে করে জয়ধ্বনি—
শতবর্ষ বেঁচে থাক তুমিই ধর্মের বাপ তুমি মা জননী।
জ্বলজ্বলে তাজা স্বপ্ন রক্ত বমনের মত
উত্তাপিত কণ্ঠস্বরে বৃথা শুধু ঝরে।
শত্রুর শঠতাচক্রে বিশ্বেসকে করে বলাৎকার
মিথ্যে দেবতার স্তবে হৃদয়ের উজ্জ্বল কুসুম
ছিঁড়ে খুঁড়ে অর্ঘ্য দিয়ে—ঘরে এসে
নিরুত্তাপ নারীর শরীর জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে।
.
এইসব মানুষেরা পথে পথে ভাসন্ত শ্যাওলা
জীবনের খরস্রোতে নেহায়েত খড়কুটো মানবিক বন্ধনবিহীন
মরুতে উদ্যানকুঞ্জ ছায়াময় ধর পাবে কই?
ঘর—সে তো অতীতের সুখস্বর্গ স্মৃতি, কদলী তরুর ঝোপ
নারকোলের হেলে পড়া ছায়া, আম কাঁঠালের বনে
নবীন ফাল্গুনে জাগা কচি কচি পল্লবের মায়া
কাকচক্ষু সরোবর মুগ্ধ চোখে আকাশ নেহারে
নদীর বঙ্কিম ধারা, বাছুরের হাম্বারব
হেমন্তে মাঠের বুকে সোনারঙ্গ ধানের জোয়ার।
নির্বাক মৃত্তিকাতলে নিরিবিলি নিদ্রা যায়
উর্দ্ধতন চতুর্দশ পুরুষের প্রাণ, রত্নের ভাণ্ডার যেন
কোলে করে শুয়ে আছে দীনহীন সরল কবর।
ঘর নেই, তবুও ঘরের মায়া প্রাণে বিঁধে আছে সর্বক্ষণ
স্বপ্নে শোনে পিতৃপুরুষের স্বর, শোনে দেয়ার গর্জন
নদীর ছলছল স্রোত চোখে ভাসে, নতুন ধানের ঘ্রাণ
মগজের কোষে, সমীরিত মাঠ জাগে মনে
রক্তের স্পন্দনে বাজে বৃষ্টির ঝঙ্কার।
শহরের ফাঁকামাঠে বাঁশে কাঠে গড়ে তারা
ঘর নয়, ঘরের বিদ্রূপ—হাওয়ার দাপটে কাঁপে
এলোকেশী বৈশাখের ঝরে ছত্রখান, মাঘের দীঘল রাতে
হিমেল ভালুক ঢুকে বিঁধায় নখর
উদ্বাস্তু গ্রামের লোক বেআব্রু জীবন
বেঁধে রাখে যেইখানে অতিকষ্টে মনে করে ঘর।
.
ধীরে ধীরে পেকে উঠে আসন্ন সময়, একদিন
বস্তিবাসী মানুষের চোখে টুটে ঘুম, অলক্ষে ওপর হতে
জরুরী হুকুম নেমে এল, হঠাৎ জঞ্জাল সব রাবিশের স্তুপ
নগরী নিশ্চিত হোক, চাঁদের কলার মত বাড়ুক লাবণী।
কেননা সংবাদ গেছে এইসব বস্তির মজুর
ফিরিঅলা মিস্তিবাহাদুর একজোটে ফন্দি আঁটে
প্রথম সুযোগে নাকি বিস্ফোরণে ফাটাবে শহর;
নীল আসমানের থেকে অগ্নিময় বজ্র টেনে
নিষ্ঠুর নগর বক্ষে ঢালবে কহর। গ্রাম খারিজের
শোধ নেবে, সোনালী শস্যের নামে লাগাবে তাণ্ডব
বইয়ে দেবে রক্ত নদী, লালে লাল হবে রাজপথ
ক্ষেপা তরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে
খুলে নেবে সভ্যতার ফ্যাকাশে বল্কল।
পাড়ায় পাড়ায় চলে প্রদীপ্ত মহড়া, কারা নাকি
নীল-নকশা লেখে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে
শোণিতের মত লাল ফুটন্ত সকাল কারা নাকি
টেনে আনে, অমর আশার তরুহিম্মতে
রোপন করে বজ্রাহত হৃদয়ের তলে, আঁটে ছল।
অগুণতি মেষের শিশু নখে-দন্তে হয়ে ওঠে খল
কি জানি কখন, তরুণ সিংহের মত একসঙ্গে করে বসে প্রচণ্ড গর্জন।
.
চারিদিকে চাপা ভয়, বাতাসে ব্যাকুল ঝরে
তুমুল রটনা, এই বুঝি প্রকম্পনে ফেটে গেল শিলা
মাটির জমাট কান্না মুক্তি পেয়ে হয়ে গেল
বীর্যবান জীবন সঙ্গীত
ঝাঁঝরা বুকের তলে হৃদপিণ্ড বাজে এযন জঙ্গের দামামা।
ইত্যাকার বার্তা শুনে বুলডোজারেরা এল
নরম মাটির বুকে এঁকে দিল সুগভীর দাগ
ক্ষুব্ধ রুষ্ট লোহার গণ্ডার, ঘুমভাঙ্গা কুম্ভকর্ণ
অন্ধরাগ নির্মম হিংসায় ছোটে ছোটে স্নেহনীড়ে
তুলে দিল ক্ষমতার ভার
দলামোচা হয়ে ভাঙে ঘরহার মানুষের ঘর।
.
অস্থিচর্মসার ন্যাংটো কালো কৌতুহলী শিশু
দেখল অবাক চোখে মানুষের আরো এক লুকোনো স্বরূপ
মারণাস্ত্রে তাক করা কালো কালো চোখ
লাজুক পাখির তুল্য নির্বাক রমণী
নিষ্প্রাণ চিত্রের মত নিথরে দাঁড়িয়ে আছে, জানে না
শুকোলো কবে অশ্রু উৎসে পানি।
বুড়োরা ঠোঁটের ফাঁকে বিড়বিড় করে উচ্চারণ
খণ্ডাতে পারে না কেউ ললাট লিখন।
অধোমুখে অপরাধী যুবাদের দল নির্বিকার সহ্য করে
বড় ব্যথা, যেন জীবন্ত ছাগল থেকে তুলে নেয় খাল।
বস্তির কুটুম সেই নির্লজ্জ কুকুর
মোটা তাজা হাড় ফেলে ঘুরে ঘুরে জুড়েছে চিৎকার।
শালিক ব্যথিত অতি ভুলে গেছে কথা
সুঠাম শিমুল তরু প্রসারিত ছায়া মেলে করে আছে চুপ
আবেগে কুসুমদল লাল অশ্রুকণা হয়ে ঝরে।
কাঁথা-বালিশের স্তুপ, হাড়ি কুড়েঘরের ভেজানো ঝাপ
খাঁচায় পোষিত পাখি, বাসন-কোসন
বালতি-মগ-হ্যারিকেন, সন্ধের চেরাগবাতি
আকাশে চক্কর দেয়া ডোরা-কাটা শান্ত কবুতর
দিশেহারা দুগ্ধবতী ছাগল জননী
দুঃখী মানুষের দুঃখে তোলে আর্তধ্বনি।
.
বাসাভাঙা পাখি প্রায় তাড়াখাওয়া গ্রামীণ মানুষ
কুয়াশার পথ বেয়ে কোন্ দিকে যায়?
কম্পিত চরণ পাতে কোন্ কথা লিখে রাখে পাথুরে রাস্তায়?
জাগ্রত হৃদপিণ্ডতলে বিদ্যুৎ চমকে
সর্বহারা হৃদয়ের অগ্নিগর্ভ বাণী
হাড়ে হাড়ে বহ্নিমান কথার ফোয়ারা
সমাচ্ছন্ন অন্ধকারে কি আবেগে ফেটে পড়ে।
মমতার লেশহীন গর্বময়ী নিষ্ঠুর শহর
ক্ষমতার ক্রীড়াক্ষেত্র অবশ্য তোমাকে দেব
দরিদ্রকে ছলনার বর, আমরা যাব না গ্রামে
শিশু কি কখনো যায় মাতৃজরায়ণে?
দলিত মথিত হব হাড়ে হাড়ে পিষ্ট হব
বিষাক্ত ভীমরুল প্রায় গুপ্তঘরে
সারারাত করে রবো চুপ।
রজনী প্রভাতকালে বহির্গত হব সব
যেন ঝাঁক ঝাঁক বোমারু বিমান।
হে শহর গর্বোদ্ধত নিষ্ঠুর শহর
তোমার সঙ্কীর্ণ বক্ষে সবান্ধবে একদিন
ঢেলে দেব মারাত্নক আজব কহর
গ্রাম খারিজের শোধ নেব, সোনালী শস্যের
নামে লাগাব তাণ্ডব, বইয়ে দেব রক্তনদী
লালে লাল হবে রাজপথ, ক্ষেপাতরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে
খুলে নেব সভ্যতার বল্কল।
.
(দুঃখের দিনের দোহা কাব্যগ্রন্থ থেকে)
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ২০৭ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন