ঘরটা নিস্তব্ধ। শুধু ভেন্টিলেটরের মৃদু গুঞ্জন আর হার্ট মনিটরের মাঝে মাঝে বেজে ওঠা শব্দ। বিশু শয্যায় শায়িত, তার দেহ দুর্বল, শ্বাস ক্ষীণ। জীবনের সমস্ত ভার যেন তার উপর চেপে বসেছে। সে জানে, সময় এসে গেছে।
কিন্তু বাইরের আলো যখন ম্রিয়মাণ, ছায়াগুলো যখন দীর্ঘতর, তার মন স্মৃতির পথে হেঁটে, হারিয়ে যায় অতীতের গলিপথে।
চোখ বুজতেই সে নিজেকে আবার ছেলেবেলায় খুঁজে পায়। সে শৈশবের সেই রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে সদ্য বানানো রুটির গন্ধ। আর সেখানে আছে তার মা। আটা মাখা তার দু’হাত, উষ্ণ আর কোমল। আটার দলাটা যত্ন আর ছন্দে মাখছে, যেন সেই ছন্দটাই ছিল বাড়ির স্পন্দন। মা মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে, চোখে ভালোবাসার কোমল আলো।
“বিশু!”—তার মায়ের কণ্ঠস্বর যেন এক সুর, যা বহু আগেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
“আমার সোনামণি!”
বিশু তার দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু মুহূর্তেই স্মৃতিটা ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল। একটা ব্যথা বুকের ভেতর . . .
এরপর সে নিজেকে খুঁজে পেল এক তরুণ হিসেবে। বাবার সঙ্গে কাঠের কারখানায় দাঁড়িয়ে আছে সে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কাঠের গুঁড়ো আর বার্নিশের গন্ধ। তার বাবা, একজন দক্ষ কারিগর, কাঠের টুকরোকে রূপ দিচ্ছে সৌন্দর্যে। বাবার হাতগুলো কঠোর, বছরের পর বছর পরিশ্রমে খসখসে। তবু সেই হাতে রয়েছে যত্ন আর নিখুঁত দক্ষতা।
“মনে রাখবি, বিশু,” বাবার কণ্ঠস্বর দৃঢ় আর স্থির, “জীবনটা এই কাঠের মতো। এটা কী রূপ পাবে, তা সম্পূর্ণ তোর ওপর নির্ভর করে।”
বিশু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, তখনকার মতো আজও সেই কথা অনুভব করল সে। কিন্তু এই স্মৃতিটাও ধীরে ধীরে মুছে গেল, রেখে গেল তার বাবার কঠিন কিন্তু স্নেহময় উপস্থিতির এক গভীর আকাঙ্ক্ষা।
তখন সে দেখল তাকে—সুদীপ্তা। তার প্রিয়তমা। তার হাসি তার মনে প্রতিধ্বনিত, একসময় যা তার পৃথিবীকে আলোয় ভরিয়ে দিত। সে তাকে দেখল, সেই প্রথম দিনের মতো, যখন তাদের দেখা হয়েছিল। সূর্যের আলো তার চুলে খেলা করছে, আর তার চোখে খেলে যাচ্ছে আনন্দের ঝিলিক। সে স্মরণ করল কীভাবে সে তার হাত ধরেছিল, কীভাবে সে চিরকালের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু সেই চিরকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল এক গাড়ি দুর্ঘটনার দিনে, যেদিন বিশু পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। প্রথমে সুদীপ্তা তার পাশে ছিল। তবু, দিন গড়িয়ে মাস পেরোতে তার উপস্থিতি কমে গেল। তার হাসি নিভে গেল। একদিন সে চলে গেল।
“আমি পারছি না, বিশু,” সে বলেছিল, চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। “আমি দুঃখিত।”
বিশু তাকে ক্ষমা করেছিল, কিন্তু তার অনুপস্থিতির ব্যথা কখনোই পুরোপুরি মুছে যায়নি।
এখন, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বিশু অনুভব করল এই সমস্ত বিচ্ছেদের ভার যেন তাকে চেপে ধরেছে। তার মা, তার বাবা . . . সুদীপ্তা—তারা সবাই চলে গেছে। আর এখন সেও যাবে।
কিন্তু যখন অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে এলো, কিছু একটা বদলে গেল। বুকে সেই দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা হালকা হয়ে গেল। এক শান্তি তাকে জড়িয়ে ধরল। সে অনুভব করল একটা উপস্থিতি, উষ্ণ আর আশ্বাসদায়ক, যেন কেউ, বা কিছু, তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
মনের চোখে সে দেখল একটা আলো, নরম আর সোনালি, যা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। সে অনুভব করল, সেই আলো যেন তাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
আর তারপর . . . বিশু তাদের দেখল—তার মা, তার বাবা, আর . . . তারা অপেক্ষা করছিল তার জন্য, তাদের মুখ আলোকিত। তার মা হাত বাড়িয়ে দিল, আর বিশু তা ধরল। মায়ের ছোঁয়া আবার অনুভব করল, সেই পুরোনো উষ্ণতা।
তার বাবা কাঁধে হাত রাখল, সেই স্পর্শের ওজন ছিল পরিচিত আর আশ্বস্ত।
আর সুদীপ্তা, এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করল –
“আমি তোমাকে খুব মিস করেছি,” সে বলল।
বিশুর হৃদয়ের গভীরে এক অমলিন আনন্দের ঢেউ। সমস্ত ব্যথা, সমস্ত দুঃখ, সমস্ত একাকীত্ব যেন মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় এল এক পূর্ণতার অনুভূতি . . .
আলো তাকে ঘিরে ধরল। বিশু শেষবারের মতো এক নিঃশ্বাস নিল। তারপর . . . সব শেষ।
হার্ট মনিটর, আর ঘরটা নিস্তব্ধ . . .
কিন্তু কোথাও দূরে, যেখানে সময় আর দুঃখ নেই, বিশু শান্তি খুঁজে পেল, পেল জীবনের সমস্ত অর্থ আর সুখ যা সে সারাজীবন খুঁজে বেড়িয়েছিল . . .
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন